আম – রাজশাহী vs চাঁপাই
শুভেচ্ছা সবাইকে।
১৮০০ সালের দিকে ফজলি বিবি নামের এক বৃদ্ধা থাকতেন গৌড়ের এক প্রাচীন কুঠিরে। তার বাড়িতে উঠানে ছিল একটি আম গাছ। গাছটির খুব যত্ন নিতেন তিনি। একবার ওই এলাকার বড় কর্মকর্তা বৃদ্ধার ঘরের কাছে ক্যাম্প স্থাপন করেন। তার আসার খবর পেয়ে বৃদ্ধা নিজের গাছের আম নিয়ে তার সাথে দেখা করতে যান। সেই আম খেয়ে ইংরেজ বড় কর্মকর্তা খুবই মজা পান এবং ইংরেজিতে আমের নাম জানতে চান। বৃদ্ধা ইংরেজির কিছুই বুঝেন না। তাই ”নেম” শব্দটি শুনে বলে ফেলেন ফজলি বিবি, সেই থেকে এই আমের নাম হয়ে যায় ফজলি আম! গল্পটা নিছকই এক প্রচলিত গল্প। সত্যতা যাচাইয়ের কোন উপায়ই নেই এখন। ল্যাংড়া, গোলাপভোগ, আম্রপালির মতো আমের নামের পেছনেও এমন বিচিত্র সব নানা গল্প চালু আছে। নামের এসব গল্প নিয়েও আছে বিতর্ক। তবে আম নিয়ে সবচেয়ে বড় বিতর্ক সম্ভবত: রাজশাহী আর চাঁপাই নবাবগঞ্জের মানুষের মধ্যে। মৌসুম এলেই কাদের আম সেরা, তা নিয়ে শুরু হয় এই বিতর্ক। আম বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই কমবেশি পাওয়া যায়, কিন্তু উত্তরবঙ্গে আমের ফলন যে সবচেয়ে বেশি, এ বিষয়ে কোন বিতর্কই নেই।
চলুন আরও একটু পেছনে ফিরে যাই, ব্রিটিশ আমলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে প্রায় ২০০ বিঘার ওপরে একটি আমবাগান গড়ে তুলেছিলেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজ শশীকান্ত আচার্য রায়বাহাদুর চৌধুরী। যা ‘রাজার বাগান’ নামে খ্যাত। বাগানটির বয়স ২০০ বছরেরও বেশি হলেও, এখনো টিকে আছে সদর্পে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে আরও একটি ঐতিহাসিক বাগান আছে, যেটি ‘চৌধুরীর বাগান’ নামে পরিচিত। প্রায় দেড়শো বছর আগে ৩৫ বিঘা জমির ওপরে মনাকশার জমিদার শাহ মোহাম্মদ চৌধুরী বাগানটি করেন। তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের দ্বারভাঙ্গা জেলার লাখবাগ, মহিশুরের টিপু সুলতানের আমবাগান এবং মুর্শিদাবাদের নবাবদের আমবাগান লালবাগ থেকে বিভিন্ন জাতের আমগাছ এনে সেখানে লাগান। সেই বাগানে ৭০টির বেশি জাতের আমগাছ আছে। চাঁপাই নবাবগঞ্জে এমন আমের বাগান আরও অনেকের আছে। বলতে গেলে, প্রতিটি সচ্ছল পরিবারেই একাধিক আমের বাগান আছে। অন্যদিকে রাজশাহীবাসীর দাবি, রাজশাহীর আমের কাছে চাঁপাইয়ের আম পাত্তাই পাবেনা। স্বাদের কথায় যখন এলাম, তখন বলাই যায়, স্বাদের দিক থেকে আমাদের আম যে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত, তা বিভিন্ন ইতিহাসের বইয়ে দেখা যায়। বিভিন্ন সময়ে বাংলায় ঘুরতে এসে প্রখ্যাত পর্যটকরা আমের সুনাম করে গেছেন তাদের ভ্রমণকাহিনীতে। বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠালকে ছাপিয়ে আম কীভাবে স্বাদের দিক থেকে ফলের রাজা হয়ে উঠলো, মজার সেই গল্পটা জেনে আসি চলুন। সম্রাট আকবরের আমের প্রতি আসক্তি নিয়ে অনেক গল্প শোনা যায়। একবার সম্রাট আকবর এক ভোজসভার আয়োজন করলেন। সেই ভোজসভায় ছিলেন মন্ত্রী আর রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। ভোজসভায় সম্রাট আকবরের একজন প্রিয় মানুষ বীরবলও উপস্থিত ছিলেন। বীরবল পেট পুরে বিভিন্ন খাবার খেলেন। বীরবল সম্রাটকে জানালেন, তিনি এত খেয়েছেন যে তার পেটে আর খাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। নতুন করে আর কিছু খেতে পারবেন না। এমন সময় বীরবলের পাত্রে দেয়া হলো কয়েক টুকরা আম। বীরবল আমের লোভ সামলাতে পারলেন না। আমের টুকরাগুলো খেলেন তৃপ্তি সহকারে। এ দৃশ্য দেখলেন সম্রাট আকবর। তিনি বীরবলকে বললেন, ‘কী বীরবল, তোমার পেটে তো জায়গা নেই? আমগুলো তো নিমেষেই সাবাড় করে দিলে!’ বীরবল সম্রাটকে মিনতি করে বললেন, ‘মহামান্য! আপনি যখন রাস্তা দিয়ে যাওয়া শুরু করেন, তখন রাস্তায় লোকজন থাকলেও তারা সরে যায়, রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়। মহারাজ আপনিও যেমন সম্রাট, তেমনি আম হচ্ছে সম্রাট বা ফলের রাজা। আমার পেট ভরা থাকলেও সে আমার পেটে জায়গা করে নিয়েছে ঠিকই।’ বীরবলের এ কথায় সম্রাট আকবর বেশ খুশি হলেন। বীরবলকে তিনি এক ঝুড়ি আম উপহার দিলেন। এই হলো আমের ‘ফলের রাজা’ উপাধি পাওয়ার কাহিনী। প্রাচীনকাল থেকে রাজসভার সদস্যদের কাছে আমের সমাদর ছিল সব ফলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এ উপমহাদেশে গড়ে উঠেছে অনেক আমবাগান। এ জন্য আম হলো রাজাদের ফল, আর ফলের রাজা আম। বিশ্বের অনেক দেশেই আম পাওয়া যায়। পাকিস্থান, ভারত ও ফিলিপাইন – এই তিনটি দেশের জাতীয় ফল আম, আর বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল হলেও জাতীয় বৃক্ষ কিন্তু আম গাছ। তবে বিশ্বে উৎপাদিত মোট আমের অর্ধেকেরও বেশি হয় ভারতে। বেশি আম উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে আছে- চীন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, পাকিস্তান ও মেক্সিকো। সে যাই হোক, আমাদের দেশের আম স্বাদে সেরা বলেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা- ভারত, পাকিস্তান, নেপাল মালয়েশিয়া, ব্রুনাই এবং ব্রিটেনের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের কাছে বারবারই উপহার হিসেবে আম পাঠান। পরিসংখ্যান বলে, বাংলাদেশ আয়তনের দিক থেকে ৯২তম হলেও আম উৎপাদনে নবম। আর স্বাদের দিক থেকে? যারা অন্তত: অন্যান্য দেশের আমের স্বাদ নিয়েছেন, তারা আমাদের আমকেই সেরা বলবেন, অবশ্যই। আরো একটা মজার তথ্য আপনাদের সাথে শেয়ার করি। আমের ইংরেজি যে ‘ম্যাংগো’, এই শব্দটির উৎপত্তিস্থল কিন্তু ইংরেজী ভাষাভাষী কোন অঞ্চল না। এর আদি উৎস ভারতের তামিলনাডুতে। তামিল ভাষায় ম্যাংগোকে উচ্চারণ হতো ‘ম্যানকেই’। পরে পর্তুগিজরা এর নাম দেন ‘ম্যাংগা’। পনেরো বা ষোল শতকের দিকে ব্রিটিশরা ম্যাংগাকে ‘ম্যাঙ্গো’ উচ্চারণ করতে শুরু করেন। সেই থেকে আমের ইংরেজি ম্যাংগো। ম্যাংগো শব্দের জন্ম রহস্য তো জানা গেল, আমের জন্ম কোথায়? বিশেষজ্ঞদের মতে, আমের আদি জন্মস্থান আসাম থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল। সে অর্থে বাংলাদেশের পূর্বাংশও আমের জন্মভূমির দাবিদার। যেসব জাতের আম এ দেশে দেখা যায়, তার অধিকাংশ জাতেরই সৃষ্টি এসব অঞ্চলে। অথচ ভাগ্যটা কী দেখুন, সেই জন্মস্থানেই আম ভালো হচ্ছে না। ভালো হচ্ছে ঠিক দেশেরই উত্তরাঞ্চলে। আর সেই উত্তরাঞ্চলের মানুষের মধ্যেই চলে বিতর্ক। সেরা আম আসলে কাদের? চাঁপাই নাকি রাজশাহীর? সেরা নির্ধারণের দায়িত্বটা আপনাদের হাতেই দিয়ে যাচ্ছি। কমেন্টে জানান, আমে সেরা কারা? রাজশাহী নাকি চাঁপাই না অন্য কেউ?
ধন্যবাদ সবাইকে, সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
Mango – Rajshahi vs Chapai
Greetings to all.
Around 1800, an old woman named Fazli Bibi lived in an ancient hut in Gaur. There was a mango tree in the courtyard of his house. He took great care of the tree. Once a high official of that area set up a camp near the old woman’s house. On hearing of his arrival, the old woman went to meet him with mangoes from her own tree. The British collector was very amused by eating that mango and wanted to know the name of the mango in English. The old woman did not understand any English. Fazli Bibi only heard the word “name” and said her name, since then the name of this mango became “Fazli mango”! The story is just a common story. There is no way to verify the authenticity at present. There are many different stories behind the names of mangoes like Langra, Golapbhog, Amrapali. There is also controversy about these stories of names. Perhaps the biggest controversy over mangoes is between the people of Rajshahi and Chapainawabganj. When the season comes, this debate begins about whose mango is the best. Mangoes are available more or less in all regions of Bangladesh, but there is no dispute that the yield of mangoes is highest in North Bengal.
Let’s go back a little further, during the British period, Maharaj Shashikant Acharya Rai Bahadur Chowdhury, the zamindar of Muktagacha of Mymensingh, built a sugarcane garden on about 200 bighas in Kansat of Shibganj upazila of Chapainawabganj. This is known as ‘Rajar Bagan’. Although the garden is more than 200 years old, it still survives beautifully. There is another historical garden in Chapainawabganj, which is known as ‘Chawdhury’s Garden’. Manaksha zamindar Shah Mohammad Chowdhury made the garden about 150 years ago on 35 bighas. He brought different varieties of Mango trees from Mughal Emperor Akbar’s Lakhbagh in Dwarbhanga district, Tipu Sultan’s Mango garden in Mysore and Lalbagh, the Nawab’s mango garden in Murshidabad, and planted them there. There are more than 70 varieties of mango trees in that garden. There are many more such Mango orchards in Chapainawabganj. In other words, every well-to-do family has more than one mango orchard. On the other hand, the people of Rajshahi claim that Chapai’s mangoes will not be compared to Rajshahi’s mangoes. When we come to the word of taste, it can be said that the fact that our Mangoes are appreciated around the world in terms of taste can be seen in various history books. Famous tourists who have visited Bengal at different times have made the mango famous in their travelogues. Let’s know the interesting story of how Mango became the king of fruits in terms of taste overtaking the national fruit of Bangladesh. There are many stories about Emperor Akbar’s addiction to Mangoes. Once Emperor Akbar organized a banquet. Ministers and important person of the state were present at that banquet. Birbal, a favorite of Emperor Akbar, was also present at the banquet. Birbal eats various foods to his full stomach. Birbal told the emperor that he had eaten so much that there was no more room in his stomach. Can’t eat anything again. At that time, a few pieces of mango were given in Birbal’s plate. Birbal couldn’t resist the temptation of mangoes. He ate the mango pieces with satisfaction. Emperor Akbar saw this scene. He said to Birbal, ‘What Birbal, there is no room in your stomach? If the mangoes are cut immediately!’ Birbal begged the emperor and said, ‘Your Highness! When you start passing through the road, even if there are people on the road, they move away, the road becomes empty. Maharaj you are the emperor, and Mango is the emperor or the king of fruits. Emperor Akbar was very happy with Birbal’s words. He gave a basket of mangoes to Birbal. This is the story of how mangoes earned the title of ‘King of Fruits’. From ancient times mangoes were held in high esteem among the royals. Many Mango plantations have been established in this subcontinent under state patronage. Mangoes are found in many countries of the world. Pakistan, India and the Philippines – the national fruit of these three countries is the mango, and the national fruit of Bangladesh is the jackfruit, but the national tree is the mango tree. However, more than half of the total mangoes produced in the world are produced in India. Major mango producing countries include China, Thailand, Indonesia, Philippines, Pakistan and Mexico. Be that as it may, because our country’s mangoes are the best in taste, Honorable Prime Minister Sheikh Hasina has repeatedly sent mangoes as gifts to the Heads of State and Government of India, Pakistan, Nepal, Malaysia, Brunei and Britain. According to statistics, Bangladesh is 92nd in terms of area but ninth in mango production. And in terms of taste? Those who have at least tasted the mangoes of other countries, will say our mangoes are the best, of course. Let me share another interesting information with you. Mango, the English word for Aam, originates from a non-English speaking region. Its origin is in Tamil Nadu, India. Mango was pronounced ‘Mankei’ in Tamil. Later the Portuguese named it ‘Manga’. Around the fifteenth or sixteenth century, the British began pronouncing manga to ‘mango’. Since mangoes are English mangoes. The secret of the birth of the word mango is known, where is the birth of mango? According to experts, the original birthplace of mango is a region stretching from Assam to Myanmar. In that sense, the eastern part of Bangladesh also claims the birthplace of mangoes. Most of the mango varieties found in this country originated in these regions. But look at the luck, the mango is not good at that place of birth. It is better in the northern part of the country. And there is a debate among the people of that northern region. Whose are the best mangoes? Chapai or Rajshahi? I leave the responsibility of determining the best to you. Tell me in the comments, who is the best? Rajshahi or Chapai no one else?
Thanks everyone, stay healthy, stay well.