ইতিহাসে
শুভেচ্ছা সবাইকে।
টাক মাথার ভুঁড়িওয়ালা, বেটে কোন লোক দেখলে কার কথা পড়বে আপনাদের? আমার কাছে কেউ প্রশ্নটি করলে, উত্তরে আমি বলতাম গোপাল ভাঁড়। গোপালের নাম শোনেননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া কঠিন। যুগ যুগ ধরে তাকে নিয়ে তৈরি হওয়া হাসির গল্পগুলো এখনো মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে।
তেমনই একটা গল্প শোনাই আপনাদের।
গোপাল এক দিন মিষ্টির দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। যাবার সময় দোকানে সাজানো মিষ্টি দেখে গোপালের খুব লোভ হলো।
এদিকে তার পকেটে তখন একটি পয়সাও নেই।
গোপাল মনে মনে ভাবল, মিষ্টি খাবার জন্য কোনো একটা বুদ্ধি বের করতে হবে।
সে দোকানে ঢুকে দেখল, দোকানদারের ছোট্ট ছেলে বসে আছে।
গোপাল জিজ্ঞেস করল, ‘কি রে, তোর বাবা কই?’
ছেলেটা বলল, ‘দোকানের পেছনে বিশ্রাম নিচ্ছে।’ গোপাল বলল, ‘তোর বাবা আর আমি খুব ভালো বন্ধু, বুঝলি? আমার নাম মাছি। কয়েকটা মিষ্টি খাই? তোর বাবা কিচ্ছু মনে করবে না।’ বলেই গোপাল টপাটপ মিষ্টি মুখে পুরতে শুরু করল। চোখের নিমিষে মিষ্টি শেষ হয়ে যাচ্ছে দেখে ছেলে চেঁচিয়ে বলল, ‘বাবা, মাছি আমাদের মিষ্টি সব খেয়ে ফেলছে!’ শুনে পেছন থেকে ময়রা বলল, ‘আরে খেতে দে! চিন্তার কিছু নেই। মাছি আর কতটুকুই বা খাবে?’
ছেলে বললো…বাবা সব খেয়ে ফেললো তো…
বাবা বললো…একটু বাতাস কর মাছি উড়ে যাবে…
অবশ্য এরমধ্যেই গোপাল ইচ্ছা মতো মিষ্টি খেয়ে বেরিয়ে গেল দোকান থেকে।
সত্যি বলতে, ঐতিহাসিক নানা ঘটনার সাথে গোপাল ভাঁড়ের গল্পগুলো এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, তাকে বাস্তব বলেই মনে হয়। গোপল কি বাস্তব কোন চরিত্র নাকি শুধুই লোককথা? উত্তর যাচাইয়ের আগে সত্য-মিথ্যে নিয়ে আরো একটি মজার গল্প শোনাই আপনাদের।
নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র একবার গোপাল ভাঁড়ের কাছে সত্য আর মিথ্যার দূরত্ব জানতে চান। বরাবরের মতোই গোপালের কৌশলী জবাব, কান আর চোখের মধ্যে দূরত্ব যতখানি, সত্য-মিথ্যার দূরত্বও ঠিক ততখানি! রাজা জিজ্ঞেস করলেন, কিভাবে? উত্তরে গোপাল ভাঁড় বলেন, যা আমরা কানে শুনি, তা সত্য-মিথ্যা দুটোই হতে পারে। তবে কোন ঘটনা যখন আমরা নিজ চোখে দেখি, তা অবশ্যই সত্য হয়। তাই সত্য আর মিথ্যের দূরত্ব কান আর চোখের মধ্যকারের দূরত্বের সমান। এই উত্তর শুনে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র খুশি হয়ে গোপালকে স্বর্ণমুদ্রা উপহার দেন। অবশ্য গল্পের এই যুক্তি মেনে নিলে স্বয়ং গোপালের অস্তিত্ব নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয়। কারণ এখনও পর্যন্ত তাকে চোখে দেখেছে এমন কাউকে আমরা খুঁজে পাইনি।
আসুন কিছু রেফারেন্স ঘেটে জানার চেষ্টা করি বিষয়টি। বাংলা সাহিত্যের বহু জায়গায় বলা হয়েছে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদদের একজন ছিলেন গোপাল ভাঁড়। এক্ষেত্রে ‘গোপাল ভাঁড়ের সন্ধানে’ বইটি হচ্ছে সবচেয়ে প্রাচীন দলিল। এছাড়া বহু বইয়ে বিক্ষিপ্তভাবে গোপালের গল্প আছে। হাসির সব গল্পেই গোপালকে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার বুদ্ধিমান সদস্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এসব গল্প আদৌ ইতিহাস থেকে নেয়া কিনা, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন।
ইতিহাসে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নামটি বেশ বিতর্কিত। শোনা যায়, বাংলায় আক্রমণের সময় আড়ালে থেকে ব্রিটিশদের সাপোর্ট দিয়েছিলেন এই রাজা। বিতর্ক যতই থাকুক, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় গুণীদের ভীষণ কদর ছিল। তিনি নিজেও সংস্কৃতমনা ছিলেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভা সম্পর্কে ইতিহাসে ভালো রকমের তথ্য পাওয়া গেলেও গোপাল ভাঁড় সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায় না। আঠারো শতকের কৃষ্ণনগরের সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি তথ্য-উপাত্ত্ব আছে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘অন্নদামঙ্গল কাব্যগ্রন্থে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নিজেই ভারতচন্দ্রের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে রায়গুণাকর উপাধী দিয়েছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র যেহেতু তার বেঁচে থাকার সময় কোন আত্মজীবনী লিখে যাননি, তাই তার সম্পর্কে এবং সেই সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক চিত্র বুঝতে অন্নদামঙ্গল কাব্যের কোন বিকল্প নেই। এখানে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের প্রশংসা যেমন আছে, তেমনি তার সভাসদদের একটি বর্ণনাও পাওয়া যায়। অন্নদামঙ্গল-এর ‘কৃষ্ণচন্দ্রের সভাবর্ধণ’ পর্ব থেকে এই পঙ্কতিগুলো দেখুন:
(মুখ কৃষ্ণজীবন কৃষ্ণভক্তের সার।
পাঠকেন্দ্র গদাধর তর্কালঙ্কার।।
ভূপতির পিসা শ্যামসুন্দর চাটুতি।
তার কৃষ্ণদেব রামকিশোর সন্ততি।।
ভূপতি পিসার জামাই তিনজন।
কৃষ্ণানন্দ মুখয্যা পরম যশোধন।।
মুখয্যা আনন্দিরাম কুলের আগর।
মুখ রাজকিশোর কবিত্বকলাধর।।
প্রিয় জ্ঞাতি জগন্নাথ রায় চাঁদ রায়।
শুকদেব রায় ঋষি শুকদেব প্রায়।।
কালিদাস সিদ্ধান্ত পণ্ডিত সভাসদ।
কন্দর্প সিদ্ধান্ত আদি কত পারিষদ।।
কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় কুলীন প্রিয় বড়।
মুক্তারাম মুখয্যা গোবিন্দভক্ত দড়।।)
হাইলাইট করা টেক্সটগুলোতে অনেক সভাসদদের নাম আছে, কিন্তু নেই গোপালের নাম। সুনীতিকুমার চট্টপাধ্যায় ও সুকুমার রায়সহ যারা গোপাল ভাঁড়ের অস্তিত্বের প্রতি আস্থাশীল, তাদের দাবি অবশ্য ভিন্ন। তারা মনে করেন, গোপালকে হিংসা করতেন ভারতচন্দ্র, সেজন্য কৌশলে গোপালের নাম এড়িয়ে গেছেন তিনি। ‘বঙ্গসাহিত্যে হাস্যরসের ধারা’ বইয়ে অজিতকুমার ঘোষও বলেছেন, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের রাজসভার ভাঁড় ছিলেন গোপাল।’ তবে ভাষাবিদ সুকুমার সেনের কাছে আবার গোপাল ভাঁড় এক কাল্পনিক চরিত্র।
গোপালের অস্তিত্বের পক্ষে-বিপক্ষের এসব প্রশ্নে যারা তর্ক-বিতর্ক করেছেন, প্রত্যেকেই জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি। কারো কথাই এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই। সেকারণে গত একশ বছর ধরে জল কেবলই ঘোলাই হয়েছে।
ঘোলা জলে আরো একটু সাঁতার কেটে আসি চলুন। জনশ্রুতি আছে, শঙ্কর তরঙ্গ নামের একজন দেহরক্ষী ছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের। উনিই আসলে আমাদের পরিচিত রসিক গোপাল ভাঁড়। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সিরাজুল ইসলামও এই জনশ্রুতিকে সত্য মনে করেন। যদিও বর্তমানে কমিক্স বই বা কার্টুন ভিডিও থেকে আমরা ভুঁড়িওয়ালা, টাক মাথার যে বেঁটেখাটো গোপালের বিবরণ পাই, তা মোটেও একজন দেহরক্ষীর সাথে মেলে না। অবশ্য গোপাল ভাঁড়ের বইগুলোর প্রচ্ছদ বা বর্তমানের অ্যানিমেটররা গোপালকে এমন একটি চেহারায় প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন, তা দেখতে দেখতে অন্য কোন চেহারার গোপালকে আমরা মানতেও পারি না। অথচ গোপাল ভাঁড়ের এমন চেহারার কোন ভিত্তি নেই বললেই চলে।
১৯২৬ সালের একটি খবরে অবশ্য নড়েচড়ে বসেছিলেন ইতিহাসবিদরা। নগেন্দ্রনাথ দাস নামের এক ব্যক্তি নিজেকে গোপাল ভাঁড়ের বংশধর বলে দাবী করে বসেন। নগেন্দ্র এনিয়ে একটি বইও লেখেন, যেখানে গোপালের বংশতালিকা বের করেন তিনি। বইয়ে নগেন্দ্রনাথ জানান, গোপালের পদবী ভাঁড় নয়, ‘গোপাল নাই’ ছিল। পারিবারিকভাবে তারা নাপিত ছিলেন। নগেন্দ্রনাথ দাসও অবশ্য শক্ত কোন প্রমাণ হাজির করতে পারেননি। আর নগেন্দ্রনাথ দাস যদি গোপাল নাই’র বংশধরই হয়ে থাকেন, তাহলে তার পদবী ‘দাস’ হলো কী করে? সে সম্পর্কেও কোন তথ্য তিনি দেননি। এও সত্যি যে, গোপালের জন্মসাল কিংবা কোথায় তিনি জন্মেছিলেন তা কোনও নথিতেও পাওয়া যায়নি। এমনকী, তাঁর জায়গা-জমি, আত্মীয়-স্বজনের বিষয়েও কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
আসলেই গোপাল ভাঁড় কি ছিলেন? আপনাদের কী মনে হয়? গোপাল ভাঁড় নিয়ে আপনার মতামত কমেন্টে লিখুন।
তবে বাঙ্গালীর জীবনে ‘গোপাল ভাঁড়, কেবল একটি নাম নয়, একটি সময়ের প্রতিচ্ছবি। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মানুষের জীবনযাপন ও রাজনৈতিক অবস্থার চিত্র উঠে আসে গোপালের গল্পে। হাসিঠাট্টার মধ্যে দিয়েই বহু অন্যায়ের প্রতিবাদও থাকে। আসলে এসব গল্পে হাস্যরসের আড়ালে লুকিয়ে থাকা জীবনশিক্ষার জোর এত বেশি যা গোপালকে সত্যি করে তুলেছে আমাদের মাঝে। আর তাই গোপাল রক্তমাংসের হোন বা না হোন, তিনি হেঁটে বেড়াবেন শতকের পর শতক। আমাদের দেশেও ক্ষমতাসীন মানুষদের পাশে তেলবাজ লোকজনে ভরপুর। তাদের পরিবর্তে দু-একজন গোপাল ভাঁড় থাকলে বোধহয় মন্দ হতো না। অন্তত হাসি-ঠাট্টার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাবানদের ভুল ধরিয়ে দিতে পারতো।
ধন্যবাদ সবাইকে।
ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
Gopal Bhar Missing in History?
Greetings, everyone!
When you see a short, bald, and chubby man, who comes to mind? If someone asked me, I’d say Gopal Bhar. It’s hard to find a Bengali who hasn’t heard of him. His humorous tales have been passed down for generations and still bring smiles.
Let me share one such story with you.
One day, Gopal was passing by a sweet shop. He saw the sweets and couldn’t resist. But he didn’t have a single coin in his pocket.
Gopal thought of a clever plan. He entered the shop and saw the shopkeeper’s young son sitting there.
Gopal asked, “Hey, where’s your father?”
The boy replied, “He’s resting in the back.”
Gopal said, “Your father and I are great friends. My name is Mochi (Fly). Can I have a few sweets? He won’t mind.”
Without waiting, Gopal began eating the sweets.
The boy shouted, “Father, Mochi is eating all our sweets!”
Hearing this, the shopkeeper shouted back from the back, “Let it eat! How much can a fly eat, anyway?”
The boy yelled, “Father, it ate everything!”
The father replied, “Just wave it off; the fly will go away.”
By then, Gopal had eaten to his heart’s content and left the shop.
To be honest, Gopal’s stories blend so seamlessly with historical events that he feels real. Was Gopal a real person or just a folk tale? Before we answer, let me share another fun story about truth and lies.
Once, King Krishnachandra asked Gopal about the distance between truth and lies. Gopal’s clever answer was, “As far as the distance between the ears and the eyes.”
The king asked, “How so?”
Gopal replied, “What we hear may be true or false. But what we see with our own eyes is always true. So, the distance between truth and lies is the same as the distance between the ears and the eyes.”
The king was so impressed that he rewarded Gopal with gold coins.
But if we accept this logic, it creates doubt about Gopal’s existence too. No one has ever seen him in person.
Let’s check some references to know more.
In Bengali literature, it’s often said that Gopal Bhar was a court jester in King Krishnachandra’s court. The book Gopal Bharer Sandhane is one of the oldest references. Many books feature Gopal’s stories, portraying him as a wise member of the king’s court. But it’s hard to say if these stories are historical.
King Krishnachandra’s name itself is controversial. It’s said he secretly supported the British during their invasion of Bengal.
Controversies aside, the king appreciated talented people. He was a patron of art and culture. History provides good information about his court, but there’s no concrete evidence about Gopal Bhar.
The most reliable details about 18th-century Krishnanagar come from Annadamangal Kabya by Bharat Chandra Raygunakar. King Krishnachandra, impressed by Bharat Chandra’s talent, gave him the title Raygunakar. Since the king didn’t leave behind an autobiography, this book helps us understand that era’s society and politics. In the chapter Krishnachandra’s Sabha Bardhan, we find these verses:
(Krishna devotees fill the court, their faces shining like Krishna himself.)
(Many scholars and poets add to the court’s prestige. From Joy to Anandiram, these names are praised.)
The highlighted texts mention many court members but not Gopal Bhar. Scholars like Suniti Kumar Chattopadhyay and Sukumar Roy, who believe in Gopal’s existence, argue that Bharat Chandra deliberately left Gopal out due to jealousy.
Ajit Kumar Ghosh mentioned in Bongosahitye Hashyarasher Dhara that Gopal was indeed a jester in King Krishnachandra’s court. However, linguist Sukumar Sen claimed Gopal Bhar was a fictional character.
Both sides have strong arguments, and ignoring either would be unfair. Over the past 100 years, this debate has only grown murkier.
Let’s dive into this murky water a little more.
It’s said that the king’s bodyguard Shankar Taranga might actually be the Gopal Bhar we know. Historian Sirajul Islam supports this idea. But the short, bald, and chubby Gopal we see in cartoons doesn’t match the image of a bodyguard. Perhaps comic books and animations have fixed a particular look for Gopal that we now can’t imagine any other way.
In 1926, something stirred historians. A man named Nagendra Nath Das claimed to be a descendant of Gopal Bhar. He even wrote a book, listing Gopal’s family tree. Nagendra said Gopal’s surname wasn’t Bhar but Nai, and that his family were barbers. But Nagendra couldn’t provide solid proof. Also, if Nagendra was Gopal’s descendant, why was his surname Das? He didn’t explain this either.
There’s no record of Gopal’s birth year, birthplace, or family. No evidence of his land or relatives either.
So, was Gopal Bhar real? What do you think? Share your thoughts in the comments.
For Bengalis, Gopal Bhar isn’t just a name; he’s a reflection of an era. His stories showcase a time’s lifestyle and political dynamics. Behind the humor lies deep life lessons. Gopal might not have flesh and blood, but he’ll walk through centuries in our imagination.
In our society too, powerful people are surrounded by sycophants. Wouldn’t it be great to have a few Gopal Bhars? At least they could point out mistakes with humor!
Thank you for reading. Stay well, stay happy!
“I appreciate the detailed explanation, very helpful!”