সোমালিয়ায় জলদস্যুদের শেয়ারবাজার
যখন আমরা এই ভিডিওটি ধারণ করছি, তখনও সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি ২৩ বাংলাদশি নাবিকসহ আস্ত কয়লাবাহী একটি জাহাজ। মোটা অংকের মুক্তিপণ না দিলে ফিরে আসার কোন সুযোগ নেই সেইসব নাবিকদের।
আরব সাগর ও লোহিত সাগরের মধ্যবর্তী সোমালিয়া উপকূলে জলদস্যুদের কারা ইন্ধন দেয়? জিম্মিদশা থেকে মুক্ত করতে কাদের হাতে মুক্তিপণের অর্থ দেয়া হয়? এসব নিয়ে আজকের ভিডিও।
জলদস্যুর কথা শুনলে প্রথমেই আমাদের মাথায় আসে ‘পাইরেটস অফ দ্য ক্যারিবিয়ান’ সিনেমার জ্যাক স্প্যারো চরিত্রে অভিনয় করা জনি ডেপের ছবি। বাস্তবে জলদস্যুদের নিয়ে দুনিয়া অবশ্য সিনেমা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর সোমালিয়ান জলদস্যুরা তো আরো ভয়ংকর। তাদের নাম শুনলেই ভেসে উঠবে রাইফেল কাঁধে কঙ্কালসার শরীর আর নিষ্ঠুর রক্তচক্ষুর ছবি। সমুদ্র থেকে জাহাজ ও অসহায় নাবিকদের জিম্মি করে মুক্তিপণ চাওয়াই এই জলদস্যুদের কাজ।
শুনতে অবাক লাগলেও, সোমালিয়ার সাধারণ মানুষই অর্থ বিনিয়োগ করে জলদস্যুদের জাহাজ অপহরণের অভিযানে পাঠায়।
জাহাজে ডাকাতি করার জন্য সোমালিয়ার একটি ‘জলদস্যু শেয়ারবাজার’ আছে। সেখানে বিনিয়োগকারীরা সম্ভাব্য অভিযানের শেয়ার কেনে। অর্থ ছাড়াও বিনিয়োগকারীরা চাইলে একে-৪৭ রাইফেল বা রকেটচালিত গ্রেনেডের বিনিয়োগ করেও শেয়ার কিনতে পারে। ৭২টির বেশি জলদস্যু গ্রুপের অস্তিত্ব আছে এই শেয়ারবাজারে। কী আশ্চর্য, তাই না? এসব গ্রুপকে ‘সামুদ্রিক কোম্পানি’ নামেও ডাকা হয়। বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা থাকে, অর্থায়ন করা সামুদ্রিক কোম্পানিটি যেন বড় কোন জাহাজ জিম্মি করতে পারে।
সোমালিয়ান জলদস্যুরা এতো এতো মুক্তিপণ নেয়ার পরও তাদের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা কাটে না কেন? এর পেছনেও আছে বেশ কিছু কারণ। লাখ লাখ ডলার মুক্তিপণের খুব সামান্যই জলদস্যুরা পায়। এতো ঝুঁকি নিয়ে এতো কম আয়, কেন? তা বুঝতে হলে আমাদের ঘটনার আরও গভীরে যেতে হবে, বুঝতে হবে জলদস্যুদের এই বিজনেস মডেলটা।
জলদস্যুদের গ্রুপ বা সোমালিয়ানদের ভাষায় ‘সামুদ্রিক কোম্পানি’ মূলত দুটি ভাগে ভাগ হয়ে কাজ করে। শেয়ার মার্কেট থেকে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান হলে একটা গ্রুপ অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে একটি মাদার ভ্যাসেল ও ছোট ছোট নৌকায় সমুদ্র যাত্রা করে। আক্রমণের জন্য খুঁজতে থাকে বিদেশি জাহাজ। পেয়ে গেলে ছোট স্পিড বোট নিয়ে টার্গেট করে পণ্যবাহী জাহাজগুলোর পেছনে ছুটতে থাকে। দস্যুদের বোটগুলো ছোট হওয়ায় পণ্যবাহী জাহাজের রাডারেও এগুলো ধরে পড়ে না। তাছাড়া বিধিনিষেধের কারণে আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলের সময় কার্গো জাহাজগুলো প্রাণঘাতী অস্ত্র ও নিরাপত্তারক্ষী রাখতে পারেনা। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগায় জলদস্যুরা। কোন একটা জাহাজকে জিম্মি করতে পারলেই, ব্যস। এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় গ্রুপের কাজ। এরা মুক্তিপণের অর্থ নিয়ে দরকষাকষির কাজটা করে, জাহাজ মালিকদের সাথে।
মুক্তিপণ আদায়ের পর অর্থ ভাগাভাগি হয় বিনিয়োগকারী ও জলদস্যুদের মধ্যে। একাধিক ব্যর্থ অভিযানে বিপুল অর্থ খরচের পর যখন সাফল্য আসে, খুব সামান্যই ভাগ পায় জলদস্যুরা। জাহাজ জিম্মি করা থেকে শুরু করে মুক্তিপণ আদায়—বিপজ্জনক কাজগুলো জলদস্যুরা করলেও, সংগৃহীত মুক্তিপণের বড় অংশই নিয়ে যায় বিনিয়োগকারীরা।
একারণেই বিপুল অর্থের লেনদেন হলেও ভাগ্য খোলে না সোমালিয়ান জলদস্যুদের। তারপরও জলদস্যুদের লাইফস্টাইল বেশ ব্যয়বহুল। হাতখুলে খরচ করতে তারা অভ্যস্ত। জলদস্যু শীর্ষ নেতারা তো একরাতের পার্টিতেই লাখ লাখ ডলার উড়িয়ে দেয় বলে খবর আছে।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ইতালিয়ান ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে ১৯৬০ সালে জন্ম হয় সোমালিয়ার। ১৯৯১ সালে সামরিক শাসনের উৎখাতের পর নৈরাজ্যের মধ্যে পড়ে দেশটি। পরের দুই দশকের বেশি সময় যুদ্ধবিগ্রহে বিধ্বস্ত সোমলিয়াতে কার্যকর কোনো সরকারই ছিল না। এই সময়টাতে আফ্রিকার মধ্যে দীর্ঘতম উপকূল সমৃদ্ধ দেশটির জলসীমার নিরাপত্তায় কোন কোস্টগার্ড বা বাহিনী ছিল না। এই সু্যোগে বিদেশি মাছধরার ট্রলার আর জাহাজগুলো সোমালিয়ান সমুদ্রসীমায় ঢুকে নিয়মিত মাছ ধরতে শুরু করে আর তেজস্ক্রিয় বর্জ্য খালাস করতে শুরু করে। জাহাজগুলো থেকে নির্গত রাসায়নিক পদার্থের কারণে সোমালিয়ান জলসীমায় মাছের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং উপকূলীয় মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অদ্ভুত রোগ ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।
তখন থেকেই জেলেরা সহজ পথে বেশি আয়ের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ে অপরাধে। তাদের দুর্ধর্ষ জলদস্যু বানাতে উঠে পড়ে লাগে সুযোগ সন্ধানী একাধিক মাফিয়া চক্র। মাছ ধরার চেয়ে দস্যুতায় আয়ের পরিমাণ অনেক বেশি হওয়ায় জেলেরা জাল ছেড়ে অস্ত্র তুলে নেয় হাতে। পরিণত হয় কুখ্যাত জলদস্যুতে। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করতে থাকে সমুদ্রের পণ্যবাহী একের পর এক জাহাজ। ধীরে ধীরে জলদস্যুরা এতোটা নৃশংস হয়ে উঠেছে নাবিকদের হত্যা করাটাও তাদের কাছে মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
সোমালি জলদস্যুদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো ওই রুটে তাদের সামরিক উপস্থিতি বাড়ায়। এর ফলে ২০১৩ সাল নাগাদ অনেকটাই কমে যায় দস্যুবৃত্তি। কিন্তু ২০১৭ সালের পর পরিস্থিতি আবারও আগের রূপ ধারণ করে। সম্প্রতি লোহিত সাগরে ইয়েমেনের ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠী বেশ কিছু জাহাজে আক্রমণ করায় যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ আন্তর্জাতিক বাহিনীগুলোকে সেইদিকে বেশি নজর দিতে হয়েছে। সেই সুযোগে ভারত মহাসাগরের গালফ অফ এডেনে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সোমালিয়ান জলদস্যুরা।
২০০৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত সময়কালে হর্ন অফ আফ্রিকার দস্যুরা কী পরিমাণ অর্থ আদায় করেছে তার একটি আনুমানিক হিসাব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সেই হিসাব অনুযায়ী জলদস্যুরা ক্রুদের জিম্মি করে সাড়ে তিনশো থেকে সোয়া চারশো মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ আদায় করেছে। ২০১২ সালের আগ পর্যন্ত এক দশকে সোমলিয়ার জলদস্যুরা ৭ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করেছে। বিপুল এই অর্থের মাত্র দুই শতাংশ গেছে সোমালিয়ার জলদস্যু ও তাদের পরিচালনাকারী দেশটির মাফিয়াদের পকেটে। এই ইন্ডাস্ট্রির বেশিরভাগ অর্থ পেয়েছে পশ্চিমা বীমা ও সমুদ্র প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলো।
ভাবা যায়, দস্যুদের দমন না করে তাদের ভয়কে ব্যবহার করে সব সময়ের মতো নিজেদের পকেট ভারী করেছে পশ্চিমারা। ২০১০ সালে সোমালি জলদস্যুরা মুক্তিপণ হিসেবে পেয়েছিলো ১৪৮ মিলিয়ন ডলার। ওই বছর বিদেশি বিভিন্ন বীমা কোম্পানি জাহাজ মালিকদের কাছ থেকে জলদস্যু সুরক্ষা হিসেবে আয় করে ১ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। জলদস্যুদের দমনে সোমালি সরকার পুলিশি তৎপরতা বাড়ানোর কথা বারবার বলে আসছে। কিন্তু বিষয়টি বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। প্রয়োগ নাই বললেই চলে। অবশ্য বিদেশি জাহাজ অপহরণ করে দস্যুরা যে অর্থ পাচ্ছে তাতে সোমালি সরকারও লাভবান হচ্ছে বটে। এ কারণেই কি দেশটির সরকার বিষয়টি নিয়ে নীরব রয়েছে?
যাই হোক গৃহযুদ্ধ, দারিদ্র্যতা আর পশ্চিমা শোষণের অবসান না হওয়া পর্যন্ত সোমালিয়ার মানুষ জলদস্যুতা থেকে বেরিয়ে আসবে না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। এক্ষেত্রে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো চাইলেই উদ্যোগী হতে পারে। তাদের সম্মিলিত চেষ্টা সোমলিয়ার জলদস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে পারে।
ধন্যবাদ সবাইকে
সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
The stock market of pirates in Somalia
When we are recording this video, Somali pirates are still holding hostage a ship full of coal with 23 Bangladeshi sailors. Those sailors have no chance to return unless they pay a huge ransom.
Who fuels the pirates on the coast of Somalia between the Arabian Sea and the Red Sea? Who is given ransom money to free from hostages? Today’s video is about these.
When we hear about pirates, the first thing that comes to our mind is the image of Johnny Depp, who has playing the role of Jack Sparrow in the movie ‘Pirates of the Caribbean’. In reality, the world of pirates is completely different from the movies. In addition, Somali pirates are even more dangerous. Just hearing their names brings up images of skeleton bodies on rifle shoulders and cruel bloodshot eyes. The work of these pirates is to take hostages of ships and helpless sailors from the sea and ask for ransom.
As surprising as it may sound, it is the common people of Somalia who invest money and send pirates on ship hijacking missions.
Somalia has a ‘Pirate Stock Market’ for robbing foreign ships. Investors buy shares of potential expeditions. In addition to money, investors can also buy shares by investing in AK-47 rifles or rocket-propelled grenades. More than 72 pirate groups exist in this stock market. What a surprise, isn’t it? These groups are also called ‘Maritime Companies’. Investors expect the financed shipping company to take on large ships.
Why do Somali pirates not cut their financial misery after taking so much ransom? There are several reasons behind this. Pirates receive very little of the millions of dollars in ransom. Why so little income with so much risk? To understand that, we need to go deeper, to understand the business model of pirates.
Pirate groups, or ‘sea companies’ in the Somali language, are divided into two groups. When the necessary funds are provided from the share market, a group sets sail with weapons and a mother vessel and small boats. Foreign ships were looking for an attack. Once found, they started chasing the cargo ships with small speed boats. Since pirate boats are small, they do not even get caught by the radar of cargo ships. Moreover, due to restrictions, cargo ships cannot carry lethal weapons and security guards on international routes. Pirates use this opportunity. If you can take a ship hostage, that’s it. Then the work of the second group began. They negotiate the ransom money with the ship owners.
After the ransom is collected, the money is divided between the investors and the pirates. After spending huge sums of money on a series of failed expeditions, when success comes, the pirates share very little. From hijacking ships to extorting ransoms—while pirates carry out dangerous tasks, the majority of the ransom collected is taken by investors.
That’s why Somali pirates’ luck hasn’t changed despite the huge amount of money being traded. Still, the pirate lifestyle is quite expensive. They are used to spending lavishly. It is reported that the top leaders of the pirates blow millions of dollars in one-night parties.
Looking at history, it can be seen that Somalia was born in 1960 after leaving Italian colonial control. After the overthrow of the military regime in 1991, the country fell into anarchy. For more than two decades, war-torn Somalia had no effective government. At this time, the country with the longest coastline in Africa had no coast guard or force to protect its waters. This allowed foreign fishing trawlers and ships to enter Somali waters to regularly fish and discharge radioactive waste. Chemicals released from the ships slowly depleted the fish population in Somali waters and a variety of strange diseases spread among the coastal people.
Since then, fishermen have become involved in crime in search of an easy source of income. It takes multiple mafia gangs looking for opportunities to make them ruthless pirates. As the income from piracy is much higher than fishing, fishermen leave their nets and take up arms. Became a notorious pirate. One by one, sea cargo ships were taken hostage at gunpoint. Gradually the pirates became so brutal that even killing sailors became a trivial matter for them.
Fed up with the violence of Somali pirates, the United Nations, European Union, NATO, United States, India, and other related countries increased their military presence on that route. As a result, by 2013, banditry had reduced considerably. But after 2017, the situation is back again. Recently, the Iran-backed Houthi rebel group of Yemen attacked several ships in the Red Sea, so international forces, including the United States and the United Kingdom, had to pay more attention to that. On that occasion, Somali pirates have become more reckless in the Gulf of Aden in the Indian Ocean.
The World Bank has provided an estimate of the amount of money pirates in the Horn of Africa took from 2005 to 2012. According to that estimate, the pirates extorted between three and a half to four hundred million US dollars by holding the crew hostage. In the decade to 2012, Somalia’s pirates created a $7-12 billion industry. Only two percent of this huge sum went into the pockets of Somali pirates and the country’s mafia who run them. Western insurance and maritime defense companies have received most of the money in this industry.
It is thought that the Westerners have made their pockets heavier as always by using their fear instead of suppressing the bandits. In 2010, Somali pirates received $148 million in ransom. That year, various foreign insurance companies earned $1.85 billion from shipowners as pirate protection. The Somali government has repeatedly spoken of increasing police activity to suppress piracy. But the matter is limited to speaking. Not applicable. Of course, the Somali government is also benefiting from the money that pirates are getting by hijacking foreign ships. Is that why the country’s government is silent on the matter?
However, it is almost certain that the people of Somalia will not get out of piracy until the civil war, poverty, and Western exploitation ends. In this case, the influential countries of the world can be proactive if they want. Their combined efforts can bring Somalia’s pirates back to normal.
Thanks, everyone
Stay healthy, stay well.