একটা ম্যাচ বাকসো, কতটুকু? ছোট্ট এইটুকু জায়গাতে ভাঁজ করে রাখা যেত পুরো একটি শাড়ি, কিংবা একটা আংটির ভেতর দিয়ে টেনে বের করা যেত বারো হাত লম্বা শাড়িটি। এমন উদাহরণগুলো হয়তো অনেকের কাছেই বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে, তাই না? মসলিন কাপড়ের বিশেষত্ব বোঝাতে এমন অনেক জল্পনা-কল্পনা রয়েছে। ম্যাচ বাকসো কিংবা আংটির ব্যাপারগুলো শুধুই কি গল্প নাকি বাস্তব? উত্তর জানতে চলুন দেখে আসি পুরো ভিডিওটি।
আজকে যে কাপড়টি নিয়ে কথা বলবো সেটি চারশো বছরের পুরনো। এই মসলিনের ইতিহাস চমকে দেয়ার মতো। বলা হতো, মসলিন কাপড় এতোই হালকা ছিল যে, যা শীতের সকালে শিশির ভেজা ঘাসের ওপর বিছানো হলে বোঝাই যেত না। কয়েক গজ কাপড় ফুঁ দিয়েই উড়িয়ে ফেলা যেত বলে একে ‘হাওয়াই কাপড়’ও বলা হতো! তবে ভয়ংকর ব্যাপারও কিন্তু আছে, অনেক রানি ও রাজকুমারী মসলিন কাপড় পড়ে রাজসভায় এসে নগ্নতার অভিযোগেও অভিযুক্ত হয়েছেন। এখন নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পারছেন, মসলিনের স্পেশালিটিটা কোথায়?
এক গ্রিক নাবিকের লেখা ‘পেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান সি’- বইয়ে মসলিন বিষয়ে দারুণ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। ইউরোপে মসলিন কাপড়ের ব্যবসা রোমানদের হাত ধরেই। ধীরে ধীরে পুরো ইউরোপেই জনপ্রিয়তা বাড়ে মসলিনের। এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন ব্রিটেনের রাণী, রাজা, বাদশা আর দিল্লীর নবাবরা।
আর এই জনপ্রিয়তাই একসময় কাল হয়ে দাড়ায় মসলিনের জন্য। তাই ব্রিটিশরা বুঝতে পেরেছিল, বিলেতি শাড়ির বাজারে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী মসলিন, আর বিলেতি শাড়ি কোনভাবেই মসলিনের সাথে ব্যবসায় টিকে থাকতে পারবে না। তাই ব্রিটিশ সরকার মসলিন কাপড়ের উপর অস্বাভাবিক কর চাপাতে শুরু করলো। বিলেত থেকে আমদানি করা কাপড়ে যেখানে কর ছিল মাত্র দুই শতাংশ, সেখানে মসলিনের উপর সত্তর থেকে আশি শতাংশ করারোপ করা হয়।
এতে মসলিনের দাম এক ধাক্কায় মানুষের হাতের নাগালের বাইরে চলে গেল। তবুও ধনীদের মধ্যে মসলিন সংগ্রহের একটা আগ্রহ ঠিকই ছিল।
ব্রিটিশরা এবার আরো নোংরা খেলা শুরু করলো। সেকালে মসলিন হতো ফুটি কার্পাস তুলার তৈরি সুতা দিয়ে। ব্রিটিশরা সেসব গাছ কেটে ফেলতে শুরু করে। অত্যাচার চালিয়ে ঘরছাড়া করলো মসলিন কারিগরদের। কোন মসলিন কারিগরের খোঁজ পেলেই আঙ্গুল কেটে দেয়ার মতো অমানবিক জঘন্য কাজ তারা করেছে। যেন তারা আর মসলিন তৈরিই করতে না পারে, না পারে উত্তরসূরী কাউকে শেখাতে।
যেহেতু মসলিন তৈরির কারিগর খুবই অল্প ছিল এবং এই জ্ঞান বংশপরম্পরায় কিছু নির্দিষ্ট পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, তাই একটা সময় মসলিন তৈরি একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। কারিগরদের উত্তরসূরীরা নানান পেশায় জড়িয়ে পড়তে থাকে। মসলিন কাপড়ও হয়ে ওঠে বিরল, ফলে আলমারি থেকে মসলিন গিয়ে ওঠে জাদুঘরের কাঁচঘেরা বাকসে। তাইতো বিশ্ব মাতানো কাপড়টির সর্বশেষ প্রদর্শনী হয়েছিল আজ থেকে ১৭৩ বছর আগে, তাও আবার ঢাকাতে নয়, লন্ডনে।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস কী জানেন? যে ব্রিটিশরা মসলিনের শত্রু হয়ে উঠেছিল, সেই ব্রিটিশদের জাদুঘরেই বাকসোবন্দি হল মসলিন। ভিক্টোরিয়া মিউজিয়ামে দুইশ’র বেশি এবং ব্রিটিশ হেরিটেজ ট্রাস্টে দুই হাজারেরও বেশি মসলিন সংরক্ষণ করে রাখা আছে।
কিন্তু এতো বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের বকবকানি এখন কেন? সেই ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটাতেই আসছি,
২০১৪ সালে মসলিন ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু মসলিনের মতোই হারিয়ে গিয়েছিল এর মূল উপাদান ফুটি কার্পাস তুলার গাছও। পরে অবশ্য সে গাছ অনেক খোজা-খুজির পর পওয়া যায় গাজীপুরের কাপাসিয়ায়, শুরু হলো চাষাবাদ, তৈরি করা হল সুতা কাটার চরকা।
যেহেতু মসলিনের সুতা তৈরিতে নরম ও সুক্ষ অনুভূতিসম্পন্ন আঙুলের প্রয়োজন, তাই কমবয়সী নারীদেরকে অন্য সব কাজ করা থেকে বিরত রাখা হলো, কাজ শুরুর প্রক্রিয়ায় লোশন মাখিয়ে আঙ্গুল নরম করে রাখা হতো কয়েক ঘন্টা আগেই। দুই বছর চেষ্টার পর সাফল্য মিলতে শুরু করে। সুতা প্রস্তুতের পর মসলিন শাড়ি বোনার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
মসলিন বোনার কারিগর খুঁজতে গিয়েও কম ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়নি। শেষ পর্যন্ত আল-আমিন নামের একজনকে পাওয়া যায়। জামদানি তৈরির এই কারিগর সাহস করে মসলিন বোনার কাজ শুরু করতে রাজি হন। মূলত: জামদানীর কারিগররা আশি থেকে দেড়শ কাউন্টের শাড়ি তৈরিতে পারদর্শী, সেখানে তিনশ কাউন্টের শাড়ি তৈরি রীতিমতো অবিশ্বাস্য ছিল তাদের কাছে।
কাজের ফলাফলে যাওয়ার আগে কাউন্টের হিসেবটা একটু বুঝিয়ে বলি, কাউন্ট হচ্ছে সুতা তৈরির এক ধরনের মেজারমেন্ট। পাঁচশ কাউন্ট সুতার মানে হচ্ছে, এক হাজার মিটার দীর্ঘ সুতা – যার ওজন মাত্র দুই গ্রাম। বুঝতেই পারছেন, মসলিন তৈরিতে কত সুক্ষ সুতায় কাজ করতে হয়।
তার ওপর আছে আবহাওয়ার ব্যাপারটাও, মসলিন বুনতে হয় উচ্চ আদ্রতায়। রুমের তাপমাত্রা ঠিক করার পাশাপাশি আদ্রতা ঠিক রাখতে বালতিতে ভরে পানি রাখা হতো। এতো কিছুর পরও সন্ধার পর মাত্র চার ঘন্টা কাজ করা সম্ভব হতো। শত বাঁধা-বিপত্তিতে প্রায়ই মনে হচ্ছিল, মসলিন বুঝি আর কখনোই ফিরে আসবে না।
কিন্তু আসে, ছয় মাস টানা কাজ করে তিনশ কাউন্টের মসলিন শাড়ি তৈরি করা হয়, আর নকশাটিও করা হয় ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা তিনশ বছর আগের একটি মসলিন শাড়ির আদলে। আর এভাবেই হয় ঢাকাই মসলিনের পুনর্জন্ম।
২০২০ সালে মসলিন প্রকল্পটির শেষ হয় মোট ছয়টি শাড়ি তৈরির মাধ্যমে এবং একটি শাড়ি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে উপহারও দেয়া হয়।
কিন্তু প্রতিটি মসলিন শাড়িতে প্রায় ছয় লক্ষ টাকা খরচ পড়েছে। বর্তমানে মসলিন তৈরির দীর্ঘ প্রক্রিয়াকে কিভাবে সংক্ষিপ্ত করা যায়, তা নিয়ে গবেষণা চলছে। সফলতা পেলে মসলিনের দামও সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে চলে আসবে বলে আশা করা যায়।
এবার মূল কথায় ফিরে আসি। শুরুতেই বলেছিলাম, মসলিন শাড়ি ছোট্ট একটি আংটির ভেতর দিয়ে নেয়া যায়, সত্যিই কি তাই?
হ্যাঁ, নতুন তৈরি মসলিন আংটির মধ্যে দিয়েই বের করা যায়। বর্তমানে পাঁচশ কাউন্টের সুতা দিয়ে মসলিন তৈরি হচ্ছে, তাতেই আংটি পরীক্ষা সফল! কিন্তু জাদুঘরে পাওয়া মসলিনের সুতা আটশ কাউন্ট পর্যন্ত ছিল। শোনা যায়, সে আমলে বারশো থ্রেড কাউন্টের মসলিন কাপড়ও তৈরি হতো। তাহলে বুঝতেই পারছেন, ‘ম্যাচ বাকসো কিংবা আংটির মধ্যে মসলিন’ কোন মিথ নয়, কোন রূপকথা নয়, মসলিনের চমক রূপকথার চেয়েও বহুগুণে চমকপ্রদ।
মসলিন আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ, গর্বের বস্তু। ঢাকাই মসলিন আবারো ফিরে আসুক তার আভিজাত্য, গৌরব আর ঐতিহ্য নিয়ে।
সবাইকে ধন্যবাদ, সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
A Lost Tradition – Muslin
Greetings to all.
“Bucks a match, how much? A whole sari could be folded into this small space, or a sari twelve cubits long could be pulled out through a ring. Such fairy tale-like examples may seem familiar to many, right? There are many speculations to explain the specialty of muslin cloth. Is the matter of the matchbox or ring just a story or reality? Let’s watch the whole video to know the answer.
The fabric I will talk about today is four hundred years old. The history of this muslin is amazing. It was said that muslin cloth was so light that it could not be understood if it was spread on dewy grass on a winter morning. It was also called ‘Hawaii Cloth’ as it could blow away a few yards of cloth! But there is also a terrible thing, many queens and princesses wearing muslin clothes came to the palace and were accused of nudity. Now surely you understand, where is the specialty of muslin?
Great information about muslin can be found in the book ‘Periplus of the Erythrean Sea’ written by a Greek sailor. In Europe, the muslin cloth business was held by the Romans. Gradually its popularity increased throughout Europe. Queens-kings of Britain, and Nawabs of Delhi were vocal in their praise of muslin.
And this popularity once became a curse for muslin. So the British government started levying exorbitant taxes on muslin cloth. While the duty on cloth imported from India was only two percent, muslin was taxed at seventy to eighty percent.
With this, the price of muslin went beyond the reach of people in one fell swoop. Yet among the wealthy, there was certainly an interest in muslin collection.
The British started playing dirtier this time. At that time, muslin was made of footy corpus cotton yarn. The British started cutting those trees. The muslin artisans were tortured and left their homes. They also did inhuman and horrible things like cutting off the fingers of any muslin craftsman. As if they could no longer make muslin, nor could they teach any successors.
As muslin-making artisans were very few and the knowledge was restricted to certain families through generations, muslin-making ceased altogether at one point. The descendants of artisans started getting involved in various professions. Muslins also became rare, so muslins went from closets to glass-enclosed boxes in museums. So the last exhibition of world recognized cloth was held 173 years ago from today, that too not in Dhaka but in London.
Do you know what is the cruel irony of fate? Muslin was boxed up in the museum of the British who became enemies of muslin. Over two hundred muslins are preserved at Museum Victoria and over two thousand at the British Heritage Trust.
But why the chatter of the lost history so many years ago? I am coming to that interesting matter.
In 2014, an initiative was taken to bring back muslin. But like muslin, the original material, the footy carpus cotton plant, was lost. Later, however, that tree was found after a lot of searching and cultivation started in Kapasia of Gazipur, spinning wheel was made.
Since muslin threading required soft and sensitive fingers, young women were prevented from doing all other work, and the fingers were softened with lotion several hours before the process began. After two years of trying, success began to come. After preparing the yarn, the process of weaving the muslin saree begins.
Searching for muslin weavers was not a hassle. At last, a man named Al-Amin was found. This jamdani maker bravely agreed to start weaving muslin. Basically, Jamdani artisans are skilled in making eighty to 150 count sarees; three hundred count sarees were unbelievable to them.
Before going to the results of the work, let me explain the calculation of the count a little, the count is a kind of measurement of yarn. That is, five hundred count yarn means a thousand-meter-long yarn – weighing only two grams. You can understand how much fine thread is required to make muslin.
On top of that, there is also the matter of weather; muslin has to be woven in high humidity. Water was kept in buckets to regulate the room temperature as well as humidity. Despite all this, it was only possible to work for four hours in the evening. In a hundred obstacles, it often seemed that Muslin would never come back.
But it comes back, it took six months of continuous work to produce a three hundred count muslin saree, and the design was modeled after a three hundred-year-old muslin saree kept in the British Museum. And this is how Dhaka is the rebirth of muslin.
In 2020, the Muslin project ended with a total of six sarees being made, and one saree was gifted to the Hon’ble Prime Minister.
But each muslin saree costs about six lakh rupees. Currently, research is underway on how to shorten the long process of making muslin. If successful, it is expected that the price of muslin will also come within the reach of common people.
Now back to the main point. I said at the beginning, muslin sari can be taken through a small ring, is it really so?
Yes, the newly made muslin can be pulled out through the ring. At present, muslin is being made with five hundred count yarn, so the ring test is successful! But the muslin yarn found in the museum was up to eight hundred counts. It is heard that muslin cloth of 1200 thread count was also made during that period. Then you can understand, ‘Muslin in a matchbox or ring’ is not a myth, not a fairy tale, the wonder of muslin is many times more surprising than a fairy tale.
Muslin is part of our historical heritage, an object of pride. May Dhakai muslin return again with its nobility, glory, and tradition.
Thank you all, stay healthy, stay well.