হর্ন – শব্দদূষণ নাকি নীরব ঘাতক? Horn in Dhaka । Sound Pollution

হর্ন- শব্দদূষণ নাকি নীবর ঘাতক?

প্রতিদিন রাজধানী ঢাকার হর্ন আপনার কানের কতটা বারোটা বাজাচ্ছে তার কোন ধারণা আছে? আপনি কি জানেন ঢাকার রাস্তায় বের হলে প্রতিমিনিটে কতবার হর্নের শব্দ আপনার কানে আঘাত করে? এতে কতটুকু ক্ষতি হচ্ছে আপনার? এনিয়ে গবেষণা কী বলছে? আজকের ভিডিওতে থাকছে সেসব কিছুই।

নগরবাসীরা কতটুকু শব্দদূষণের ঝুঁকিতে আছেন-চলুন কিছু গবেষণা রিপোর্ট ঘেটে জানার চেষ্টা করি। শব্দ দূষণের ৫৬-৬০ ভাগই হয় গাড়ির হর্ন থেকে। শুধু রাজধানী ঢাকার কথা বলতে গেলে চোখ কপালে উঠতে পারে। নাক, কান গলা ইনস্টিটিউট-এর গবেষণা রিপোর্ট বলছে, রাজধানীতে দেড় মিলিয়নের বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে হর্নের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শ্রবণ শক্তি হারাচ্ছে বছরে ২৬ শো মানুষ। মাতৃগর্ভ থেকেও প্রতিবছর বধির হয়ে জন্ম নিচ্ছে আড়াই হাজারের বেশি শিশু।

এবারের তথ্যগুলো শুনে আৎকে ওঠতে পারেন। ঢাকার ৭০টি পয়েন্টে সবচেয়ে বেশি হর্ন বাজে। প্রতিমিনিটে ১ হাজারের বেশি। এরমধ্যে সবার উপরে আছে ফার্মগেট। ভয়ানক বিষয় হচ্ছে আইন করে নিষিদ্ধ করা হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে রাস্তা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গাড়িগুলো। আমদানি নিষিদ্ধ থাকলেও ঢাকার যত্রতত্র মিলে এই হাইড্রোলিক হর্ন।

বারডেমের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকার ৬০ ভাগ মানুষ থাকেন ব্যস্ত সড়কের পাশের বিল্ডিং বা অ্যাপার্টমেন্টে। নিয়মিত হর্নের যন্ত্রণায় তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ মানুষই কানে কম শোনেন। যা হয়তো তারা নিজেরাও জানেন না। জার্নাল অব এনভায়োরনমেন্ট এন্ড পাবলিক হেলথের আরেকটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, হর্নের কারণে ঢাকার ২৫ শতাংশ মানুষের ভাল ঘুম হয়না।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, একজন মানুষ ৪০ ডেসিবল শব্দে কথা বলে আর সহ্য করতে পারে ৭০ ডেসিবল মাত্রার শব্দ। সে বিষয়টি মাথায় রেখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা- ব্যস্ত শহরগুলোতে পিক আওয়ারে গাড়ির হর্নের সর্বোচ্চ মাত্রা ৫৫ ডেসিবল রাখার পরামর্শ দেয়। কিন্তু ঢাকায় পিক আওয়ারে শব্দের মাত্রা ছাড়িয়ে যায় ৮৫ ডেসিবল। ক্ষেত্র বিশেষে তা কখনো কখনো ১১৫ ডেসিবলও ছাড়ায়। যা একজন মানুষের কানের সহ্য ক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি। শিশুদের জন্য এই অভিজ্ঞতা আরও ভয়ানক।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ মানুষকে সাময়িকভাবে এবং ১০০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ সম্পূর্ণ বধির করে দিতে পারে। এতো সব ঝুঁকি কি আমরা আদৌ পরোয়া করছি?  

শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারার পেছনে একটি কারণ অধিক জনসংখ্যা। পরিসংখ্যান অনুসারে, ঢাকার প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৪৮ হাজার মানুষ বসবাস করে। বিপুল এই মানুষের চলাচলের জন্য যানবাহনেরও প্রয়োজন। আর ছোট শহরে অধিক যানবাহনের কারণে শব্দ দূষণ কমছে না। বিআরটিএ-র হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে আরো তিন বছর আগেই রেজিস্টার্ড গাড়ির সংখ্যা ৪০ লাখ ছাড়িয়েছে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বেশি হওয়ায় ব্যস্ত সময়ে ঢাকার প্রায় প্রতিটি সিগন্যালে দীর্ঘ যানজট লেগেই থাকে। আর দীর্ঘ সময় যানজটে বসে থেকে বিরক্ত হয়ে অযাচিত হর্ন বাজান চালকেরা। আর কার আগে কে যাবেন, এই প্রতিযোগিতায় নেমে ভাঙ্গেন, ট্রাফিক আইন।

আইনের কথায় যখন আসলাম, তখন হর্ন নিয়ে বাংলাদেশের আইনে কী আছে তা একটু বলি- ১৯৮৩ সালের মোটরযান আইনের ৩৯ ধারা অনুযায়ী, নিষিদ্ধ হর্ন অর্থাৎ হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করলে জরিমানা হবে ১০০ টাকা। মানে আইন ভাঙ্গলে আপনাকে দিতে হবে বর্তমান বাজারে এক কেজি সবজির সমান দামের অর্থদন্ড। 

বর্তমান প্রেক্ষাপটে আইনটি অনেক পুরনো। কারণ এখন সবাই ইলেকট্রিক হর্ন ব্যবহার করছে। তাহলে বলুন, এর প্রয়োগটা করবেন কীভাবে? শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬- এ বলা হচ্ছে, অনুমতি ছাড়া জোরে জোরে শব্দ করলে শাস্তি আছে। প্রথমবার একমাসের জেল বা ৫ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা দুটোই। এক ব্যক্তি দ্বিতীয়বার আইন ভাঙ্গলে ছয় মাসের জেল বা ১০ হাজার টাকা জরিমান কিংবা দুটোই। সবই বুঝলাম। কিন্তু চ্যালেঞ্জটা- প্রয়োগের বেলায়।

পুরোনো আইনের কথা বাদ, ২০১৮ সালের রোড ট্রান্সপো‍র্ট অ্যাক্টের ৮৮ ধারাতেও হর্ন বাজিয়ে শব্দ দূষণ করলে ৩ মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা কিংবা দুটো শাস্তি হতে পারে। আইনে সুর্নিদ্দিষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায় এর প্রয়োগ নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তোলেন।

চলুন, এবার বিদেশ থেকে ঘুরে আসি। জেনে নেই, জ্যাম থেকে বাঁচতে তারা কী ব্যবস্থা রেখেছেন। যানবাহনের শহরখ্যাত লন্ডন শহরটিতে যেমন ঘনবসতি রয়েছে তেমনি যানবাহনের পরিমাণও অনেক। কিন্তু সার্বিক চিত্রটা ঢাকার ঠিক উল্টো। পরিকল্পিত নগরায়ন, চারতলা বিশিষ্ট আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেল, ইন্টারসেকশানগুলোতে আন্ডারগ্রাউন্ড লাইন করে দেয়ার কারণে কোন ধরনের যানজট বা ট্রাফিক সিগন্যাল ছাড়াই যাতায়াত করতে পারছে লন্ডনের মানুষ। যেখানে যানজট নেই সেখানে হর্ন বাজানোর বিষয়টিও নেই। তাছাড়া হর্ন বাজানোকে অনেকটা ‘গালি’র সাথেই তুলনা করে সেখানকার মানুষ।

তুরস্কের আঙ্কারা শহরের চিত্রও একই। মানুষের সংখ্যা অনেক। নেই মেট্রোরেল। রয়েছে বিপুল পরিমাণে প্রাইভেট কার। তারপরও নেই যানজট কিংবা হর্ন। সম্পূর্ন সিগন্যাল বাতির নির্দেশনায় চলছে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ। শুধু শহরের প্রধান প্রধান সংযোগ সড়কগুলোতে সিগন্যাল এড়াতে মাটির নিচে টানেল করে দেয়া হয়েছে। এতে কোন ধরনের সিগন্যাল ছাড়াই আন্ডারগ্রাউন্ড সড়ক ব্যবহার করে গন্তব্যে পৌঁছানো যাচ্ছে মুহুর্তেই। এভাবে বেশিরভাগ উন্নত দেশই জনসংখ্যা আর গাড়ীর চাপ সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রেখে, হ‍র্ন ব্যবহার কমিয়ে এনেছে।

এবার জেনে নেয়া যাক হর্ন নিয়ে চিকিৎসকরা কী বলেন? তাদের মতে, দীর্ঘদিন অতিরিক্ত শব্দ কানের ভেতরের পর্দাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কমতে থাকে শ্রবণ শক্তি। অনেকে অবশ্য টেরও পান না বিষয়টি। এতো গেল শ্রবণ শক্তি কমে যাওয়ার বিষয়। এবার আসি, অতিরিক্ত শব্দ কীভাবে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, উচ্চমাত্রার শব্দ মানুষের শরীরে অ্যাড্রেনালিন হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এতে শরীরে রক্তচাপ ও হার্টবিট বাড়তে থাকে। ফলে রক্ত জমাট বেঁধে স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার বন্ধ করা গেলে, হয়তো বিশ্বের শীর্ষ শব্দ দূষণের নগরী হিসেবে ঢাকার যে দুর্নাম তা কিছুটা হলেও ঘুঁচবে। পাশাপাশি স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালের মতো হর্ন-নিষিদ্ধ এলাকাগুলোতে আইনের সঠিক প্রয়োগ দরকার। এতোদিনের অভিজ্ঞতায় এটা বোঝা গেছে, জেল-জরিমানা করে হর্ণ বাজানো পুরোপুরি বন্ধ করা অসম্ভব। এজন্য সচেতনতার বিকল্প নেই। সত্যটা হলো, সমাধান আপনার হাতেই। আগামী প্রজন্মের জন্য শব্দ দূষণমুক্ত সুন্দর দেশ গড়তে পারেন আপনি নিজেই…চলুন হর্ন ব্যবহারে সতর্ক হই…ঢাকার শব্দদূষণকে ঢেকে দেই সচেতনতার চাদরে। সবাইকে ধন্যবাদ, সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।


Horn in Dhaka

Do you have any idea how much the horn of the capital Dhaka is harming your ears every day? Do you know how many times the sound of the horn hits your ears every minute when you go out on the streets of Dhaka? How much damage is it to you? What does research say about it? Today’s video contains all of these. . .

To what extent are urban dwellers at risk of noise pollution. Let’s find out some research reports. 56-60% of noise pollution is from car horns. Just talking about the capital city, Dhaka, can raise the eyes. According to the research report of the Nose, Ear and Throat Institute, more than one and a half million people in the capital are directly or indirectly affected by horn. 26 percent of people lose their hearing a year. Every year more than two and a half thousand children are born deaf even from the mother’s womb.

According to a study by BIRDEM, 60 percent of people in the capital Dhaka live in buildings or apartments next to busy roads. 40 percent of them suffer from hearing loss due to regular tinnitus. Which they may not even know. According to another report of the Journal of Environment and Public Health, 25 percent of people in Dhaka cannot sleep well because of the horn.

In medical terms, a person speaks at 40 decibels and can tolerate 70 decibels. With that in mind, the World Health Organization recommends keeping car horns at a maximum level of 55 decibels during peak hours in busy cities. But the noise level exceeds 85 decibels during peak hours in Dhaka. In some areas, it sometimes emits 115 decibels. That is more than twice the capacity of a human ear. The experience is even more terrifying for children.

According to the World Health Organization, sound levels of 60 decibels can cause temporary deafness and 100 decibels can cause total deafness. Do we really care about all these risks?

One of the reasons behind the inability to control noise pollution is overpopulation. According to statistics, about 48 thousand people live in per square kilometer of Dhaka. Vehicles are also needed for the movement of these huge people. And in small towns noise pollution is not reduced due to more vehicles. According to BRTA’s calculations, the number of registered vehicles in Bangladesh exceeded 4 million three years ago. Due to the large number of vehicles on the road, there are long traffic jams at almost every traffic signal in Dhaka during peak hours. And the drivers honked their horn unnecessarily after sitting in the traffic jam for a long time. And who will go first, break the traffic law in this competition.

When I come to the word of the law, let me tell you a little about what is there in the law of Bangladesh about the horn – According to Section 39 of the Motor Vehicle Act, 1983, if you use a prohibited horn i.e. a hydraulic horn, you will be fined 100 taka. It means that if you break the law, you will have to pay a fine equal to the price of one kg of vegetables in the current market.

In the present context, the law is very old. Because now everyone is using electric horn. So tell me, how to apply it? The Noise Pollution Control Rules 2006 state that there is a penalty for making loud noise without permission. First time one month imprisonment or 5 thousand rupees fine or both. A person who violates the law for the second time is liable to imprisonment for six months or a fine of Tk 10,000 or both. I understand everything. But the challenge is in implementation.

Apart from the old law, section 88 of the Road Transport Act 2018 also provides for 3 months imprisonment or 10,000 taka or both for causing noise pollution by honking the horn. Due to lack of specific interpretation in the law, many people question its application.

Let’s talk about abroad. Let’s understand what arrangements they have made to avoid the jam. Known as the city of vehicles, London is densely populated as well as the volume of vehicles. But the overall picture is just opposite of Dhaka. People of London can travel without any kind of traffic jams or traffic signals due to planned urbanization, four-story underground metrorail, underground lines at intersections. Where there is no traffic, there is no honking. Moreover, the people there compare the horn playing with ‘Gali’.

The picture is the same in the Turkish city of Ankara. The number of people is large. No Metrorail. There are a large number of private cars. Still no traffic jams or horns. Traffic control is under the direction of full signal lights. Only the main connecting roads of the city have been tunneled underground to avoid signals. In this, the destination is reached instantly by using the underground road without any kind of signal. Thus, most developed countries have reduced horn usage by keeping population and traffic pressure under control through proper management.

Now, let’s find out what the doctors say about the horn? According to them, prolonged exposure to noise damages the inner ear. Hearing power decreases. Many people do not even realize this. So much for hearing loss. Now let’s see how excess noise increases the risk of heart disease. Medical science says that loud noise increases the level of adrenaline hormone in the human body. Blood pressure and heart rate increase in the body. As a result, the risk of stroke and heart attack increases due to blood clotting.

If the use of hydraulic horns is stopped, perhaps Dhaka’s reputation as the world’s top noise pollution city will be somewhat dented. Besides, there is a need for proper enforcement of the law in horn-ban areas like schools, colleges, universities and hospitals. Experience so far has shown that it is impossible to completely stop honking with jail-fines. There is no substitute for awareness. The truth is, the solution is in your hands. You yourself can build a beautiful country free of noise pollution for the next generation…let’s be careful in using the horn…cover Dhaka’s noise pollution…under the cloak of awareness…thanks everyone, stay healthy, stay well.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top