চূয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার জাকির হোসেন। বয়স ৩০ পেরোয়নি। পেটের দায়ে গরমের কথা না ভেবে জমিতে বীজ বুনতে গিয়েছিলো। কিন্তু ভাগ্যটা খারাপ বলেই সেদিন ঘরে ফেরা হয়নি তার। সূর্যের তাপে হিটস্ট্রোকে মারা যায় এই টগবগে যুবক।আসলেই সময়টা এখন খুবই খারাপ যাচ্ছে। সূর্যের তাপকে পাত্তা না দিলেই মহাবিপদ। জাকিরের মতো যারা মাঠে-ঘাটে দিনমজুরের কাজ করে তারা এখন উভয় সংকটে। হয় না খেয়ে থাকো, না হয়- কড়া রোদে মাঠে গিয়ে কাজ করো। দেশে এবার সবচেয়ে বেশি গরম চুয়াডাঙ্গা জেলায়। তাপমাত্রায় রেকর্ডের পর রেকর্ড। ৪২ ডিগ্রী সেলসিয়াস গরম সহ্য করে দিন কাটাচ্ছে জেলার মানুষ। গরমে দিনে কাজ করা যাচ্ছেনা। আবার রাতে হচ্ছেনা ঠিকমতো ঘুম। চুয়াডাঙ্গা নিয়ে ইদানিং একটা প্রশ্ন প্রায়ই শোনা যায়। শীত আর গরমে বারবার কেন এই এক জেলাতেই রেকর্ড হয়? শীতকালে এখানে যেমন হাঁড়কাপানো শীত তেমনি গ্রীষ্মকালেও কাঠফাটা রোদ, ভ্যাপসা গরম। এর কারণটা কী?
বিশেষজ্ঞদের মতে, সৌদি আরব এবং আফ্রিকার মরু অঞ্চলের সমান্তরালে থাকা এই চূয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে গেছে কর্কটক্রান্তি রেখা। সূর্য এখানে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত মাথার ওপর থাকে। সেইসাথে এপ্রিলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তর ও মধ্য প্রদেশের শুষ্ক গরম আবহাওয়া বয়ে যায় চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে। এই লু হাওয়ার সঙ্গে সূর্যের বাড়তি তেজ, তাপমাত্রা সবসময় ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে এই সময় পারদ উঠে যায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। সমতলভূমি বেশি থাকায় দেশের উত্তর-পশ্চিমের এই জেলাগুলোতে সূর্যের তাপ সরাসরি পড়ে। আর দীর্ঘসময় তাপদাহ থাকে।
শুধু উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল নয়, এবারে সূর্যের তাপে পুড়ে যাচ্ছে গোটা দেশ। স্যাটেলাইটে এই ইমেজটা দেখুন, মানচিত্রের যেখানেই পয়েন্টার রাখবেন, তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসেরও বেশি। রোদের তেজ এতোটাই যে, তাপমাত্রায় এবার সৌদি আরব, ওমান, সুদান, দক্ষিণ আফ্রিকাকেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ।
বলা হচ্ছে, গরম তো সবে মাত্র শুরু। অন্য বছরগুলোর অভিজ্ঞতা এবার আর কাজ করবেনা। এপ্রিলেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে মে মাসে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে, তা চিন্তা করলেই মাথা খারাপ হয়ে যাবে সবার।
এখন যদি বলি সূর্যের তাপ আমাদের দেশকে গরিব বানাচ্ছে, শুনে অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই? অবাক হলেও কিছু করা নাই, এটাই বাস্তব। বাংলাদেশে জনসংখ্যার তিনভাগের দুইভাগ শ্রমজীবী মানুষ। জিডিপিতে তাদের কন্ট্রিবিউশন অর্ধেকের বেশি। প্রচন্ড রোদে তারাই মাঠে-ঘাটে, খেটে কাজ করে। কী পরিমাণ শ্রমিক উন্মুক্ত পরিবেশে কাজ করে, সে ডেটা না থাকলেও কিন্তু গরমে তারা অল্পতেই যে দুর্বল হয়ে পড়ে সেটা সত্য। আর এখানেই অর্থনৈতিক ক্ষতিটা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার অনুমান, শুধু গরমের কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে দৈনিক কর্মঘন্টা ২ শতাংশ কমে যাবে। সহজে যদি বুঝতে চান, তাহলে এটা ৮ কোটি মানুষের একদিনের ফুলটাইম কাজ করার সমান। কোল্ড চেইন কাঠামো দুর্বল হওয়ায় গরম বেশি পড়লে পণ্য পরিহণ করতে গিয়ে প্রচুর খাবার-দাবারও নষ্ট হয়। এখন এইসব ফিরিস্তি নিয়ে যদি হিসাবে বসি, যে সংখ্যা উঠে আসবে তা শুনলে চোখ কপালে উঠে যাবে সবার। গরমে আর্থিক ক্ষতি নিয়ে মার্কিন দাতব্য সংস্থা আরশট-রকেফেলার ফাউন্ডেশন ২০২৩ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১২টি শহর নিয়ে একটা গবেষণা চালায়।ফলাফলে দেয়া যায়, শুধু ঢাকাতেই অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে যেটুকু কাজ আমরা করতে পারছিনা, তার আর্থিক মূল্য ৬০০ কোটি ডলার। যা ঢাকার মানুষের মোট বার্ষিক শ্রমক্ষমতার ৮ ভাগ। বিশেষজ্ঞরা সবকিছুর জন্য দায়ী করছে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনকে।
শুধু কী বাংলাদেশ, জলবায়ু পরিবর্তন পুরো বিশ্বের চেহারা পাল্টে দিচ্ছে। এর উদাহরণ হতে পারে, সম্প্রতি মরুর দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভয়াবহ বন্যা হলো। জলবায়ুর এই খারাপ দিক নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও আলোচনা কম হয়নি। জাতিসংঘ ১৯৯৫ সালে থেকে আয়োজন করছে জলবায়ু সম্মেলনের। এসব সম্মেলনে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃস্বরণ ৪৩ শতাংশ কমিয়ে আনার টার্গেট নিলেও পরিস্থিতি যেই লাউ সেই কদু। সবচেয়ে বেশি কার্বণ নিঃস্বরণকারী চীন- যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোও চায় না এই চুক্তির বাস্তবায়ন। মাঝে বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ১০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তার কথা উঠে। দেয়ার কথা ছিলো উন্নত দেশগুলোর। কিন্তু যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তা না দেয়ার মতোই। এখান থেকে বাংলাদেশ হয়তো ২০০ মিলিয়ন ডলারের মতো এডাপ্টেশন ফান্ড পাবে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। অবশ্য একটা আশার বাণী শোনা যাচ্ছে। এডিবি, আইএমএফ আর বিশ্বব্যাংক মিলে বাংলাদেশের জন্য একসাথে ৫ বিলিয়নের একটা বিশেষ তহবিল গঠনের পরিকল্পনা করছে। না পাওয়া পর্যন্ত এ নিয়ে কিছু বলাও যাচ্ছেনা।
দেশের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার পেছনে অন্যদের দোষারোপ না করে নগর পরিকল্পনার দিকেও নজর দেয়া উচিত। আমরা তো ইউরোপ-আমেরিকাকে অনুসরণেই চলছি সবকিছুতেই। তাদের দেখে বড় বড় কাচেঁর ভবন বানাচ্ছি।
আমরা একবারও কী ভাবছি, এই ভবনগুলো থেকে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে তাপমাত্রা দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। অবকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে শীতপ্রধান দেশগুলোকে অনুসরণ না করে, আমাদের উচিত সিঙ্গাপুরের মতো দেশকে অনুসরণ করা। যাদের আবহাওয়া আমাদের মতোই এবং যারা বনায়নকে গুরুত্ব দিয়ে ভবন বানাচ্ছে।
এতোক্ষণ ভিডিওটি দেখে আপনারা হয়তো ভাবছেন আমরা শুধু সমস্যা নিয়ে কথা বলবো। সমস্যার পাশাপাশি সমাধানের উপায় নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। এক্ষেত্রে আপনার, আমার এমনকি প্রশাসনেরও অংশগ্রহণ জরুরি এসব নিয়ে। যারা এই ভিডিও দেখছেন তাদের সবার আগে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। প্রশাসন তাদের জায়গায় কাজ করছে। সে জায়গায় আমাদের তেমন কিছু করারও নাই। কিন্তু নিজেদের সুস্থ রাখতে আমরা অন্তত কিছু ব্যাপারে সচেতন থাকতে পারি। এই যেমন ধরুন- ডাক্তারদের পরামর্শ মতো, তীব্র তাপদাহ থেকে বাঁচতে সাদা বা হালকা রঙের ঢিলেঢালা সুতির জামা পরতে পারি। ঘরের ভেতর বা ছায়ায় থাকার চেষ্টা করি। বাইরে গেলে অবশ্যই ছাতা আর ক্যাপ সাথে রাখি। যারা বাইরে গরমে কাজ করি, তারা অন্তত মাথার ওপর ছাতাটা রাখি। প্রচুর পরিমানে পানি, খাবার স্যালাইন আর জুস খেয়ে শরীরের পানির ঘাটতি পূরণ করবে। আর সর্বোপরি আমাদের প্রিয় পৃথিবীটাকে সুস্থ ও ভাল রাখতে যখন, যেখানে, যেভাবে সুযোগ পান, গাছ লাগান। বনায়ন উজাড় করে নগরায়নের পথে হেঁটেই আজ আমরা বিপদে। সবার একটু সচেতনতা- সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি গোটা বিশ্বকে বদলে দিতে পারে, অপেক্ষা শুধু সময়ের।
ধন্যবাদ সবাইকে, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
People are Restless in Intense Heat
Zakir Hossain, a resident of Damurhuda Upazila in Chuadanga. At less than 30 years old, he ventured into the fields to sow seeds, driven by the necessity to provide for his family despite the intense heat. Sadly, he did not return home that day. The young man died of heatstroke in the heat of the sun. Those like Zakir who work as day laborers in the fields and streets are now in dillema. Either stays without food, or goes and works at the field in the hot sun.
Chuadanga district is the hottest in the country this time. It creates record after record of temperature. People of the district are spending the day with 42 degree Celsius heat. Due to the hot weather, nobody can go outside to work during the day, and no one can sleep properly at night. Recently a question is often heard about Chuadanga. Winter or summer, why record in this specific district? In winter, it is bitterly cold, and in summer, it is hot and sunny. What is the reason for this?
According to experts, the tectonic line passes over this ridge in Chuadanga, running parallel to the desert regions of Saudi Arabia and Africa. The sun is overhead here from March to June. Also in April the dry hot wind of West Bengal, Bihar, Uttar Pradesh and Madhya Pradesh in India flows over Chuadanga. Along with this hot wind, the sun’s extra brightness, the temperature always increases by 2 degree celsius. As a result, the mercury rises above 40 degrees Celsius during this time. As the flat lands are high, the heat of the sun falls directly on these districts in the north-west of the country. And this runs for a long time.
Not only the north-western region, this time the whole country is getting burnt by the heat of the sun. Look at this satellite image; wherever you place the mouse pointer on the map, the temperature is over 35 degrees Celsius. The sun shines so much that Bangladesh has surpassed Saudi Arabia, Oman, Sudan and South Africa in terms of temperature.
It is said that summer has just begun. The experience of other years will not work this time. If this is the case in April then what awaits us in May will make everyone vertiginous.
Now if I say that, the heat of the sun is making our country poor, surely you are surprised. Although surprised, nothing has to do, this is real. Two-thirds of the population in Bangladesh is day labor. Their contribution to GDP is more than half. They work in the fields and under the hot sun. Although there is no data on how many workers work in open environments, it is true that they are being slightly weaker in the heat. And here are the economic losses.
The International Labor Organization estimates that global daily working hours will decrease by 2 percent by 2030 due to heat alone. If you want to understand easily, then this is equivalent to 80 million people working full time for a day. As the cold chain structure is weak, a lot of food is also wasted during the transportation of the product when the temperature is too high. Now if we sit down with these data, the number will make everyone terrified. The American charity organization named Arshot-Rockefeller Foundation conducted a study on financial losses in summer in 2023 on 12 cities in different countries. The results show that the amount of work that we cannot do in Dhaka alone due to excessive temperature is worth 6 billion dollars. This is 8 percent of the total annual labor capacity of the people of Dhaka. Experts blame it all on global climate change.
Only Bangladesh, climate change is altering the face of the whole world. An example of this can be, recently there was a terrible flood in the desert country of the United Arab Emirates. The discussion about this bad side of the climate has not decreased in the international circles. The United Nations has been organizing the climate conference since 1995. Despite the targets set at these conferences to limit global warming to 1.5 degrees Celsius and reduce carbon emissions by 43 percent by 2030, the situation remains unchanged. Countries like China and USA, who are emitting the most carbon, do not want the implementation of this agreement. Sometimes there is a discussion of 100 billion dollar aid to affected countries like Bangladesh. Developed countries were supposed to give this money. But the allocation given is the same as not given. From here, Bangladesh may get adaptation fund of 200 million dollars, which is much less than the requirement. However, there is a message of hope. ADB, IMF and World Bank together are planning to create a special fund of 5 billion for Bangladesh. Nothing can be said surely about it until it is found.
Instead of blaming others for rising temperature in the country, urban planning should also be looked at. We are following Europe-America in everything. By following them, we are making big glass buildings.
What do we even think; the temperature is doubled due to the reflection of sunlight from these buildings. Instead of following cold countries in building infrastructure, we should follow countries like Singapore. Those who have a climate similar to ours and prioritize forestry in their building construction.
After watching the video for so long, you might think that we will only talk about problems. We want to talk only about the problem as well as the solution. In this case, the participation of you, me and even the administration is necessary. Those who are watching this video need to be aware first.
Administration is working in their place. We have nothing to do there. But we can at least be aware of some things to keep ourselves healthy. For example, as advised by doctors, we can wear white or light colored loose cotton clothes to avoid severe heatstroke. Try to stay indoors or in the shade. When going out, definitely keep umbrella and cap with you. Those who work outside in hot weather, at least keep the umbrella over their heads. Consuming plenty of water, saline foods and juices will fill the body’s water deficit. And above all, plant trees whenever, wherever, however you get the chance to keep our beloved earth healthy and well. Today we are in danger by walking on the path of urbanization by deforesting. A little awareness of everyone can change society, state and even the whole world, it’s just a matter of time.
Thanks everyone, stay well, stay healthy.