রহস্যঘেরা অ্যান্টার্কটিকা- Mysterious Antarctica

১৮৪০ সালে অ্যান্টার্কটিকার বরফঘেরা ড্রেক চ্যানেল পাড়ি দিচ্ছিল ‘হোপ’ নামের একটি তিমি শিকারি জাহাজ। যেতে যেতে হঠাৎ দূর থেকে বরফে আটকে থাকা একটি পরিত্যক্ত জাহাজ দেখতে পান হোপ-এর নাবিক। কয়েকজন ক্রুকে নিয়ে কাছে গিয়েই দেখলেন জাহাজটির গায়ে লেখা- ‘জেনি’। জাহাজের কেবিনে পা দিতেই চমকে উঠলেন নাবিক। চেয়ারে বসে আছে একটি লাশ। ঠান্ডায় জমে যাওয়া লাশটির সামনে পড়ে ছিল একটা লগবুক। লগবুকে লেখা, ‘৪ মে, ১৮২৩। ৭১ দিন ধরে কোনো খাবার নেই। আমিই একমাত্র বেঁচে আছি।’

লগবুক থেকে আরও জানা যায়, জাহাজটি ১৮২২ সালের নভেম্বরে বরফের ফাঁদে আটকা পড়ে। অনেক চেষ্টা করেও বরফের পাহাড় ভাঙা যায়নি। আর এজন্যই ঠান্ডায় জমে মারা যায় জাহাজের সব আরোহী।

অ্যান্টার্কটিকা অভিযানের এই মর্মান্তিক ঘটনা পরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে পড়লে তা আদৌ সত্য কিনা, সেই রহস্য ভেদ করা যায়নি। এই মহাদেশের আকার, আয়তন, এমনকি অনেক রহস্যময় ঘটনা নিয়ে আগ্রহেরও শেষ নেই মানুষের।

আমরা সাধারণত অ্যান্টার্কটিকাকে মানচিত্রের তলানিতে ছড়িয়ে থাকা বিশৃঙ্খল আকৃতির একটি মহাদেশ হিসেবেই দেখি। অনেক সময় মানচিত্রে এটিকে ঠিকভাবে দেখানোও হয় না। কিন্তু বাস্তবে এটা কতটা বিশাল, তা ধারণা করাই কঠিন।

যদি অ্যান্টার্কটিকাকে আমরা উত্তর আমেরিকার মানচিত্রের ওপর রাখি তাহলে দেখা যাবে এটি যুক্তরাষ্ট্রের মূল ৪৮টি অঙ্গরাজ্যের থেকেও বড়। আবার, যদি অ্যান্টার্কটিকাকে ইউরোপের উপর রাখি, এটি নরওয়ে ও ফিনল্যান্ডের উত্তর প্রান্ত থেকে ইরান ও ইরাক পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।

আরো সহজ করে বলি, আমেরিকা এবং মেক্সিকোর মোট আয়তন অ্যান্টার্কটিকার সমান।

এত বিশাল একটি এলাকা – কিন্তু জনশূন্য। তবে আপনি যদি ভাবেন, অ্যান্টার্কটিকা একেবারেই জনমানবহীন, তাহলে ভুল করছেন। শীতের সময় এখানে মাত্র হাজারখানেক মানুষ থাকে। কিন্তু গ্রীষ্মকালে সেই সংখ্যাটি বেড়ে প্রায় ৫ হাজার পর্যন্ত পৌঁছায়।

এত কম জনসংখ্যার কারণ কী?

শীতল তাপমাত্রা তো একটা কারণ বটেই। কারণ শীতে অন্ধকারে ঢাকা থাকে পুরো মহাদেশ, এবং তাপমাত্রা মাইনাস ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায়, যা জীবনযাত্রাকে অনেক কঠিনতর করে তোলে।

তবে, শুধু প্রতিকূল আবহাওয়াই নয়, অ্যান্টার্কটিকার জনসংখ্যা কম থাকার আরেকটি কারণ হলো এর ভৌগোলিক অবস্থান এবং বিপজ্জনক যোগাযোগ ব্যবস্থা।

এই মহাদেশ পৃথিবীর একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে। এর সবচেয়ে কাছের বড় শহর আর্জেন্টিনার উশুয়া, তাও প্রায় ১,০০০ কিলোমিটার দূরে। উশুয়া থেকে অ্যান্টার্কটিকা যেতে হলে ব্যবহার করতে হয় ড্রেক প্যাসেজ, যা বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক সমুদ্র পথগুলোর একটি।

উত্তাল আর উঁচু ঢেউয়ের সাথে তীব্র ঠান্ডা মোকাবেলা করে এই প্যাসেজ পাড়ি দেওয়া নাবিকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। অ্যান্টার্কটিকা বরফে ঢাকা থাকলেও এর ভেতরে লুকিয়ে আছে প্রচুর ভূতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক বিস্ময়।

এই মহাদেশের বিভিন্ন অংশ আগ্নেয়গিরি দিয়ে বেষ্টিত। এখানে আছে মাউন্ট ইরেবাস, পৃথিবীর সর্বদক্ষিণের সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। এর অভ্যন্তরে আছে এক বিশাল লাভার লেক, যা ১৯৭০ সাল থেকে জ্বলছে। আগ্নেয়গিরি থাকলেও শীতকালে এই অঞ্চলের তাপমাত্রা মাইনাস ৬২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায়, যা মানুষের ত্বককে কয়েক মিনিটের মধ্যেই বরফ বানিয়ে দিতে পারে।

এমনকি, এখানে গরম পানি বাতাসে ফেলা হলে তা মাটিতে পড়ার আগেই বরফ হয়ে যায়। মাউন্ট এরেবাসের নিচে একটি রহস্যময় জগৎ রয়েছে, যা মানুষের কল্পনারও বাইরে।

আগ্নেয়গিরির তাপ বরফের নিচে কয়েক দশক ধরে সুড়ঙ্গ তৈরি করেছে। এই সুড়ঙ্গগুলোতে তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠতে পারে, যা অ্যান্টার্কটিকার মতো শীতল অঞ্চলে অদ্ভুত এক উষ্ণ আশ্রয়স্থল তৈরি করছে।

ভাবতে পারেন, এত বরফের মাঝেও এমন একটি উষ্ণ স্থান!

২০১৭ সালে একদল গবেষক মাউন্ট এরেবাসের এই সুড়ঙ্গ থেকে মাটি সংগ্রহ করে এবং সেখানে অ্যালগি, শ্যাওলা বা ছোট ছোট প্রাণীর ডিএনএ খুঁজে পায়।

এর মধ্যে কিছু প্রাণীর ডিএনএ মানবজাতির কাছে এখনো অজানা।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বরফের নিচের এই উষ্ণ গুহাগুলোতে এমন সব প্রাণী থাকতে পারে যা আমরা এখনো আবিষ্কার করতে পারিনি। অ্যান্টার্কটিকায় এমন কিছু এলাকা আছে যেগুলোকে পৃথিবীর সবচেয়ে শুষ্ক এলাকা বললে ভুল হবে না।‘ড্রাই ভ্যালিস’ নামে পরিচিত এসব এলাকায় বৃষ্টি হয়নি অন্তত ২০ লাখ বছর।

ব্যাপারটা অদ্ভুত না?

অ্যান্টার্কটিকার বরফের নিচে ৬৭৫টি তরল হ্রদও আছে। এগুলো ১৯৯০-এর দশকে প্রথম আবিষ্কৃত হয়।

অয়াকন্টার্কটিকার আরেকটি আশ্চর্যজনক স্থান হলো ‘লেক ভোস্তক’।  ৪ কিলোমিটার বরফের নিচে চাপা এই হৃদটি প্রায় ১৫ মিলিয়ন বছর ধরে বিচ্ছিন্ন। এখানকার পানি মারাত্বক ঠান্ডা। তাপমাত্রা মাইনাস তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিজ্ঞানীরা নাকি সেখানে এমন অজানা জীবের অস্তিত্ব পেয়েছেন, যা পৃথিবীর আর কোথাও নেই।

গবেষকদের মতে, এই হ্রদে পাওয়া পানির পরিমাণ লেক মিশিগানের চেয়েও বেশি এবং এটি পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম হ্রদ। আগেই বলেছি, ‘লেক ভোস্তকের’ পানি মাইনাস ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় থাকে। তবে বরফের নিচের ভূ-তাপের কারণে এটি তরল অবস্থায় থাকে।

এছাড়াও, ১৯৫৮ সালে সোভিয়েত গবেষকরা অ্যান্টার্কটিকার বরফের নিচে একটি বিশাল পর্বতমালা আবিষ্কার করেন, যা গ্যাম্বার্টসভ পর্বতমালা নামে পরিচিত। এই পর্বতমালা প্রায় ১,২০০ কিলোমিটার বিস্তৃত এবং ২,৭০০ মিটার উঁচু।

যদিও এটি পুরোপুরি বরফের নিচে ঢাকা। সত্যি বলতে, অ্যান্টার্কটিকার বরফের নিচে লুকিয়ে থাকা রহস্যগুলো এখনো আমাদের কাছে অজানা। এখানে আরও অনেক কিছু আবিষ্কার বাকি রয়েছে, যেমন বরফের নিচে থাকা জীবাশ্ম, গুহা এবং নতুন জীববৈচিত্র্য।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অ্যান্টার্কটিকা কারা নিজেদের দাবি করছে? আর্জেন্টিনা, চিলি, যুক্তরাজ্য, এমনকি রাশিয়া—সবার নজর এই মহাদেশের দিকে।

কারণ, এখানে লুকিয়ে আছে বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ—বিশেষ করে তেল।

২০২৪ সালে রাশিয়ানরা আবিষ্কার করলো অ্যান্টার্কটিকার বরফের নিচে রয়েছে এক বিশাল তেলক্ষেত্র। রয়েছে ৫১১ বিলিয়ন ব্যারেল তেলের সম্ভাবনা। এর বাজারমূল্য প্রায় ৪৪ ট্রিলিয়ন ডলার! জাপান সরকারের এক বছরের বাজেট যেখানে এক ট্রিলিয়ন ডলারের মতো, সেখানে ৪৪ ট্রিলিয়ন ডলার তো আর চাট্টিখানি কোন বিষয় নয়।

তবে এখনকার আন্তর্জাতিক চুক্তির কারণে কেউ সেখানে খনন করতে পারছে না। তবে এই চুক্তি শেষ হবে ২০৪৮ সালে।

তারপর কী হবে?

আসলে অ্যান্টার্কটিকার প্রকৃতি, ভৌগোলিক বৈচিত্র্য এবং অজানা জীববৈচিত্র্য মানুষের জ্ঞানের সীমাকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ করছে। আর তেলের মতো বিশাল সম্পদ লুকিয়ে থাকার কারণে অদূর ভবিষ্যতে এই মহাদেশ বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রে চলে আসতে পারে।

আমরা কি সত্যিই প্রস্তুত এই মহাদেশের স্বতন্ত্র পরিচয় আর পরিবেশ ঠিক রেখে এর রহস্য উন্মোচনের জন্য? নাকি প্রাকৃতিক সম্পদের লোভে বিশ্ব এটিকে ধ্বংস করবে?

এসব প্রশ্নের উত্তর সময়ই বলে দেবে।

অ্যান্টার্কটিকার রহস্যময় অজানা ভুবন উন্মোচনে মানুষ কতদূর যেতে পারে, সেটা এখন দেখার অপেক্ষা।

ধন্যবাদ সবাইকে।

সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।

Mysterious Antarctica

In 1840, a whaling ship named ‘Hope’ was crossing the icy Drake Channel in Antarctica. While traveling, the sailors of Hope spotted an abandoned ship stuck in the ice from a distance. As they approached with a few crew members, they saw the name ‘Jenny’ written on the ship’s hull. Upon stepping into the cabin, the sailors were shocked—a corpse was sitting on a chair, frozen stiff. In front of the corpse lay a logbook. The logbook read: “4 May 1823. No food for 71 days. I am the only one alive.”

The logbook revealed that the ship had been trapped in ice since November 1822. Despite numerous attempts, they couldn’t break through the icy barriers, and all aboard perished, frozen to death.

This tragic story of an Antarctic expedition became widely known, but whether it was true remained a mystery. Antarctica’s size, expanse, and many mysterious events continue to intrigue humanity.

We usually view Antarctica as a chaotic-shaped continent sprawled at the bottom of the map, and often, it isn’t depicted accurately on maps. But in reality, its size is hard to comprehend.

If placed over the map of North America, Antarctica would appear larger than the contiguous 48 states of the U.S. If placed over Europe, it would stretch from the northern tip of Norway and Finland to Iran and Iraq.

To put it simply, Antarctica is as large as the combined areas of the U.S. and Mexico.

This vast area, however, is uninhabited. But if you think Antarctica is completely devoid of human presence, you’re mistaken. In winter, its population is around 1,000 people, but during summer, this number increases to nearly 5,000.

Why is the population so low?

One reason is the freezing temperatures. In winter, the continent is shrouded in darkness, and temperatures drop below -34°C, making life extremely difficult.

However, harsh weather isn’t the only reason. Antarctica’s geographical location and treacherous accessibility also contribute to its sparse population.

Located at the southernmost tip of the Earth, the closest major city is Ushuaia, Argentina, which is about 1,000 kilometers away. To reach Antarctica from Ushuaia, one must cross the Drake Passage, one of the most dangerous sea routes in the world.

Navigating this passage with its stormy and towering waves, combined with the biting cold, is a significant challenge for sailors. Despite being covered in ice, Antarctica holds immense geological diversity and natural wonders.

Parts of this continent are surrounded by volcanoes. It is home to Mount Erebus, the southernmost active volcano on Earth, which contains a massive lava lake that has been burning since 1970. Even with its volcanic activity, winter temperatures in this region drop to -62°C, capable of freezing human skin within minutes.

Here, even hot water thrown into the air freezes before reaching the ground. Beneath Mount Erebus lies a mysterious world beyond human imagination.

The heat from the volcano has created tunnels beneath the ice over decades. In these tunnels, temperatures can reach up to 25°C, creating a surprisingly warm refuge in Antarctica’s frigid environment.

Imagine, such a warm place amidst all that ice!

In 2017, a group of researchers collected soil samples from these tunnels and discovered DNA from algae, moss, and small creatures. Some of these DNA samples are still unknown to humanity.

Scientists believe that unknown species might inhabit these warm caves beneath the ice.

There are regions in Antarctica so dry they are considered the driest places on Earth. Known as the ‘Dry Valleys,’ these areas haven’t experienced rainfall in at least two million years.

Isn’t that astonishing?

There are also 675 liquid lakes hidden beneath Antarctica’s ice, first discovered in the 1990s.

One of the most remarkable places is Lake Vostok, buried under 4 kilometers of ice and isolated for nearly 15 million years. The water here is exceptionally cold, with a temperature of -3°C. Scientists claim to have found unknown life forms in this lake, not found anywhere else on Earth.

According to researchers, Lake Vostok contains more water than Lake Michigan and is the sixth-largest lake in the world. The water remains liquid due to geothermal heat beneath the ice, despite its sub-zero temperatures.

In addition, Soviet researchers discovered a massive mountain range beneath Antarctica’s ice in 1958, known as the Gamburtsev Mountains. This range spans about 1,200 kilometers and reaches heights of 2,700 meters, although it is entirely covered by ice.

The mysteries beneath Antarctica’s ice remain largely unknown. There is much yet to be discovered, including fossils, caves, and new biodiversity.

Now, who claims ownership of Antarctica? Argentina, Chile, the United Kingdom, and even Russia—all have their eyes on this continent.

The reason is the vast natural resources hidden here, particularly oil.

In 2024, Russians discovered a massive oil reserve beneath Antarctica’s ice, estimated to hold 511 billion barrels of oil, valued at approximately $44 trillion. Considering Japan’s annual budget is about $1 trillion, $44 trillion is no small matter.

However, due to current international treaties, no one is allowed to drill there. But this treaty will expire in 2048.

What happens next?

Antarctica’s nature, geographical diversity, and unknown biodiversity continue to challenge human knowledge. The vast resources hidden here might push this continent to the center of global politics in the near future.

Are we truly prepared to uncover its mysteries while preserving its unique identity and environment, or will the lure of resources lead the world to destroy it?

Only time will answer these questions.

How far humanity will go to unravel the mysteries of Antarctica’s enigmatic world remains to be seen.

Thank you, everyone. Stay healthy, stay well.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top