শুভেচ্ছা সবাইকে।
বেশ ক’দিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা ভিডিও ভাইরাল। গার্ডের বেতন বছরে ১৫ কোটি টাকা। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বা ব্যাংকের এমডি হলে এই বেতন মানা যেতো কিন্তু লাইট হাউজের একজন গার্ডের এতো বেতন, সত্যি অবাক করার মতো।
এটাই সেই লাইট হাউজ। যার দেখভাল করলেই মিলবে মাসে কোটি টাকার বেশি। যারা এই চাকরীতে আগ্রহী তারা বিজ্ঞপ্তিটি দেখে নিতে পারেন। মজার বিষয় হলো বয়স আঠারো পেরুলেই এই চাকরীতে আবেদন করা যাবে। গ্রাজুয়েশন শেষ করার কোন বাধ্যবাধকতা নাই। তবে হ্যাঁ, নির্ধারিত একটা সময় কোথাও থাকার ক্ষেত্রে কোন আপত্তি করা যাবে না। সুবিধা হলো এখানে বসের প্যারা নাই। ইচ্ছামতো ঘুমাতে পারবেন। ঘুম ভাঙ্গলেই চোখের সামনে বিশাল সমুদ্র। বড়শি দিয়ে তাজা মাছ ধরে খাবেন। দায়িত্ব শুধু একটাই, ঠিকমতো লাইটহাউজের লাইট জ্বলছে কিনা খেয়াল রাখা। কি, শান্তি তাই না?
এতোক্ষণ ধরে যে ভালো ভালো কথাগুলো বলছি তা এখানেই শেষ।
কারণ ফ্রান্সের জুমন লাইট হাউজে কাজ করতে গেলে এক প্রকার প্রাণ হাতে নিয়েই যেতে হবে। কারণ এটা পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ চাকরির একটা। উত্তাল সাগরের মাঝে থাকা এই লাইট হাউজে একাকী দিন কাটানো মোটেও সহজ কোন কাজ নয়।
এই চাকুরির জন্য যারা সিভি পাঠানোর কথা ভাবছেন.. তাদের বলছি, ভাই এখানে চাকরি নিলে কথা বলারও মানুষ খুঁজে পাবেন না। থাকতে হবে একা। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার, ঝড় উঠলে সাগরের ঢেউ লাইট হাউজের টাওয়ারকেও ছাপিয়ে যায়। তাই যে কোন সময় মৃত্যুর ঝুঁকিও আছে। এই ছবিটা ভালোভাবে দেখলেই বুঝতে পারবেন, কতোটা বিপজ্জনক।
এখন নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে- এই লাইট হাউজগুলোর দরকার কী আসলে? আর কেনই বা এখানে সারাক্ষণ লাইট জ্বালিয়ে রাখতে হবে?
এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ইতিহাসের পাতায়।
আগেকার দিনে লম্বা সফরের জন্য বেছে নেয়া হতো সমুদ্র পথকে। কাঠের তৈরি জাহাজে চড়ে নাবিকরা সমুদ্রে যাত্রা করতেন। সাগরের নীচে পাথরের ধাক্কায় কাঠের তৈরি বহু জাহাজ ডুবে প্রাণহাণি ঘটেছে বহুবার। সবচেয়ে বেশি জাহাজ ডুবির ঘটনার সাক্ষী প্রশান্ত মহাসাগর। সেসময় নাবিকরা তীরের দূরত্ব সম্পর্কে জানতো না…গন্তব্য ঠিক করতো চাঁদ, তারা, সূর্য দেখে। গুগল ম্যাপ দেখেও এখন আমরা অনেক সময় ভুল রাস্তায় ঢুকে পড়ি। আর সেখানে আগের দিনের নাবিকেরা কিভাবে জাহাজ চালাতো, একবার ভাবেন তো? আকাশ যখন কালো মেঘে ছেয়ে যেত, বেশিরভাগ জাহাজ পথ হারিয়ে ফেলতো। যে বেসিক কিছু নেভিগেশনের যন্ত্র সাথে থাকতো, সেগুলো অনেকসময় আরও বড় বিপদ ডেকে আনতো তাদের জন্য।
এজন্য সমুদ্রযাত্রায় অলিখিত নিয়ম মেনে.. সূর্যোদয়ের সাথে জাহাজ নিয়ে বের হতেন নাবিকরা, আর সূর্য ডোবার আগেই তীরে ভেড়াতেন। আর না ফেরা জাহাজের জন্য মশাল জ্বালিয়ে তীরে অপেক্ষায় থাকতেন নাবিকদের স্বজনেরা। তখন থেকেই লাইট হাউজের ধারণা।
সবার আগে লাইট হাউজ তৈরি হয় ভূমধ্যসাগরে। এর পেছনেও আছে আরেক গল্প। সময়টা খ্রিষ্ট্রের জন্মেরও ২৮৪ বছর আগের । মিশর শাসনে তখন টলেমি দ্য সেকেন্ডে ফিলাডেলফাস। আর আলেক্সান্দ্রিয়ায় ছিলো দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। বিদেশী বহু মালবাহী জাহাজ ভিড়তো এখানে। কিন্তু এই বন্দরে জাহাজ নোঙর করানো ছিল কষ্টসাধ্য।
এই ছবিটা দেখুন, সেসময় জাহাজ নোঙরের জন্য সরু এই পথ ব্যবহার হতো। কিন্তু রাতের বেলায় এই পথ খুঁজে পাওয়া ছিল বেশ কঠিন। একটু এদিক সেদিক হলেই সাগরের ডুবন্ত পাথরে ধাক্কা লেগে উল্টে যেত জাহাজ। বিষয়টি নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান সম্রাট টলেমি। নিরাপদ নৌ-পথ তৈরির লক্ষ্যে তিনি ডেকে পাঠান সে সময়ের মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার সোস্ট্রাটাস অব সিডাসকে। যিনি বহু চিন্তা করে আলোকযুক্ত একটি মিনার বানানোর প্রস্তাব দেন। যুক্তি দেন এই আলোর মিনার দেখেই জাহাজগুলো সঠিক রুটের নির্দেশনা পাবে। সেই প্রস্তাবে সাড়া দেন সম্র্রাট টলেমি। গ্রেটেস্ট এই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নাম দেয়া হয় দ্য ফারোস অব অ্যালেক্সান্দ্রিয়া। সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি এই লাইটহাউজের উচ্চতা ছিল ৩৮৪ ফুট। লাইটহাউজের চূড়ায় এমন একটি চেম্বার তৈরি করা হয়, যেখানে সবসময় আগুন জ্বলতো। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হতো কাঠের ব্যবহার হতো, সেই সাথে তেল। প্রাচীনকালে বিশ্ব সপ্তাশ্চর্যের তালিকায়ও জায়গা করে নিয়েছিলো এই ফারোস অব অ্যালেক্সান্দ্রিয়া।
সোস্ট্রাটাস এই বাতিঘরের আলো বাড়ানোর জন্য আয়না এবং লেন্স ব্যবহার করেন। যে আলো দেখে মাইলের পর মাইল দূরে থাকা জাহাজগুলোও ঠিক নির্দেশনা পেত। ধীরে ধীরে এই লাইট হাউজের চর্চা গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
অবশ্য শুরুর দিকে লাইটহাউজ বানানো হতো সাগরের কিনারায়। সময়ের সাথে সাথে সমুদ্রপথে বাণিজ্য বাড়তে থাকায়, যেসব পথে সাগরের নীচে পাথর বেশি থাকে সেসব জায়গায় লাইট হাউজ বানানো শুরু হয়।
শুরুতে লাইট হাউজে আগুনের ব্যবহার করা হলেও ধীরে ধীরে জায়গা করে নেয় মোমবাতি, গ্যাস বাতি আর তেলের বাতি। বাল্ব আবিষ্কারের পর লাইট হাউজেও শুরু হয় ইলেকট্রিক বাল্বের ব্যবহার। কারণ এসব বাল্বে আলো বেশি ছড়াতো। এরপর আসে লাইট হাউজ থেকে দূরে আলো ছড়ানোর প্রযুক্তি। যার জন্য ১৮০০ ওয়াটের রিফ্লেক্টর লেন্স ব্যবহার হতো বাল্বের পেছনে। এই লেন্সের অপ্টিক্যাল সিস্টেমের উদ্দেশ্যই ছিল আলো সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট একটি দিকে ছড়িয়ে দেয়া। এতে কয়েক মাইল দূরে আলো পৌঁছানো যেত।
এর কিছুদিন পর রিফ্লেক্টরকে লাইটের পেছন থেকে সরিয়ে- সামনে আনা হয়। এতে আলোটা সরু হয়ে অনেকদূর গেলেও লাইটের উজ্জলতা কমে যাচ্ছিলো। সবশেষ আবিষ্কার নিয়ে হাজির হন ফরাসি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও ফিজিসিস্ট জন ফ্রেনল। তিনি খাঁজ কাটা আকৃতির সিঙ্গেল ডিরেকশনের এমন এক লেন্স তৈরি করেন, যা দিয়ে সরু আলোকরশ্মিকে বিশাল আকৃতিতে রূপ দেয়া সম্ভব হয়। তার এই আবিষ্কার লাইট হাউজ ধারণার বিপ্লব ঘটায়।
তবে সমুদ্রের বুকে প্রথম লাইট হাউজ নির্মিত হয় ইংল্যান্ডে, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে। নাম ছিলো এডিস্টোন লাইটহাউজ। আটলান্টিক মহাসাগরের ইংলিশ চ্যানেলের কাছে এডিস্টোন নামের একটি আধডোবা পাহাড়ের ওপর তৈরি হয় এই লাইটহাউজ। জোয়ারের সময় বহু জাহাজ এই ডোবা পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ডুবে গেছে। এই সমস্যা থেকে বাঁচতে সেখানে লাইটহাউজ তৈরির প্ল্যান করেন জাহাজ ব্যবসায়ী ও নাবিক হেনরি উইনস্ট্যানলি। তিন বছরের অক্লান্ত চেষ্টায় ১৬৯৮ সালে প্রথমবারের মতো তৈরি হয় মাঝ সমুদ্রে বাতিঘর। অবশ্য ১৭০৩ সালের প্রলয়ঙ্করী এক ঝড়ে লাইট হাউজটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। পরে আরও কয়েকদফায় বিভিন্নজন এটি নির্মাণ করেছেন। সবশেষ ১৮৮২ সালে স্যার জেমস এন ডগলাসের তত্ত্বাবধানে চতুর্থবারের মতো ওই স্থানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বাতিঘর নির্মাণ করা হয়।
বর্তমানে লাইট হাউজে ব্যবহার হচ্ছে এলইডি লাইট। এতে কম খরচে বেশি আলো পাওয়া যায় এবং বেশ টেকসইও হয়। তাছাড়া সেন্সর এবং টাইমার ব্যবহার করে দূরে থেকেই এসব লাইটহাউজের আলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
লাইটহাউজের সাথে বর্তমানে আরো যুক্ত হয়েছে রেডিও বীকন প্রযুক্তি। যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে সাগরে থাকা জাহাজগুলোকে সংকেত পাঠানো যায়। সেসব সংকেত ধরা পড়ে জাহাজের নেভিগেশন সিস্টেমে। তা দেখেই সঠিক পথ নির্ধারণ করতে পারে জাহাজগুলো।
এছাড়া এখন জিপিএস এবং এআইএস প্রযুক্তি থাকায় জাহাজের ক্যাপ্টেনরা সহজেই লাইটহাউজের অবস্থান জেনে নিরাপদে চলাচল করতে পারেন। বর্তমানে পৃথিবীতে ১৮ হাজার ৬০০টি বাতিঘর আছে, যার মধ্যে ৬টি বাংলাদেশে।
মনে আছে, ভিডিওর শুরুতেই বলেছিলাম ঝুঁকিপূর্ণ জুমন লাইটহাউজের কথা। যেখানে চাকরি পেলেই বছরে মিলবে ১৫ কোটি টাকা। এতো ব্যাখ্যার পর আপনার সিদ্ধান্ত কী? ঝুঁকি নিয়ে লোভনীয় বেতনের সেই চাকরিতে যোগ দেবেন, নাকি যেমনটা আছেন, যেভাবে চলছে নিজের জীবন, সেভাবেই আলো খুজেঁ নেবেন। আপনার ভাবনা কমেন্টে জানান।
ধন্যবাদ সবাইকে
সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
15 crore Taka per year of service
Greetings everyone.
A video has gone viral on social media over the past several days. It claims that the salary of a lighthouse guard is 15 crore BDT per year. While such a salary might be acceptable for the Managing Director of a multinational company or bank, the salary of a lighthouse guard is quite surprising.
This is the lighthouse in question. If you take care of it, you will earn more than a crore taka per month. Those interested in this job can check the notification. Interestingly, you can apply for this job after turning eighteen, with no requirement for a graduation degree. However, there is a stipulation to stay in one place for a fixed period. The advantage is the lack of a boss; you can sleep whenever you wish, and when you wake up, the vast sea is in front of your eyes. You can catch and eat fresh fish with a stick. The only responsibility is to ensure that the lighthouse lights are burning properly. Peaceful, isn’t it?
But this is the end of the good news. If you want to work at Jument Lighthouse in France, you must be prepared to risk your life. It is one of the most dangerous jobs in the world. Spending lonely days in this lighthouse in the middle of the stormy sea is not easy at all.
For those considering sending their CVs for this job, let me tell you: if you take a job here, you will not even find people to talk to. You must be alone. The most frightening thing is that when a storm comes, the sea waves can even overwhelm the lighthouse tower. There is a risk of death at any time. If you look closely at this picture, you will understand how dangerous it is.
Now, the question must be raised: what is the need for these lighthouses, and why do the lights need to be kept on all the time?
To answer these questions, we must go back through the pages of history.
In earlier times, sea routes were preferred for long journeys. Sailors navigated the seas in wooden ships, and many lives were lost when ships sank after hitting rocks at the bottom of the sea. The Pacific Ocean has witnessed the highest number of shipwrecks. At that time, sailors did not know the distance to the shore. They navigated by looking at the moon, stars, and sun. Even with Google Maps, we sometimes take wrong turns; imagine how sailors in the past managed to navigate! When the sky was covered with dark clouds, most ships lost their way. The basic navigation devices they carried often posed an even greater danger.
According to the unwritten rules of seafaring, sailors would set out with the sunrise and return to shore before sunset. Sailors’ relatives would wait on the shore, lighting torches for ships that did not return. This is where the concept of the lighthouse began.
The first lighthouses were built in the Mediterranean. There is another story behind this. Around 284 years before Christ, Egypt was ruled by Ptolemy II Philadelphus, and Alexandria was the country’s most important port. Many foreign cargo ships docked there, but it was difficult to anchor ships in the port.
Look at this picture: at that time, this narrow passage was used for anchoring ships. Finding this path at night was difficult, and ships would often hit submerged rocks and overturn. Emperor Ptolemy was concerned and called Sostratus of Sidus, a brilliant engineer of the time, to build a safe sea route. Sostratus proposed building a minaret with light, arguing that it would guide ships correctly. Emperor Ptolemy agreed. This greatest piece of engineering is called the Pharos of Alexandria. This white marble lighthouse was 384 feet tall. A chamber at the top housed a fire that always burned, using wood and oil as fuel. The Pharos of Alexandria was once listed among the seven wonders of the world.
Sostratus used mirrors and lenses to amplify the lighthouse’s light, allowing ships miles away to navigate correctly. Gradually, the practice of building lighthouses spread worldwide. Initially, lighthouses were built on the edge of the sea. As seaborne trade increased, they began to be built along rocky seabeds.
Fire was initially used in lighthouses, but over time candles, gas lamps, and oil lamps replaced it. After the invention of the light bulb, electric bulbs were used in lighthouses because they emitted more light. Later, technology developed to spread light further from the lighthouse, using an 1800-watt reflector lens behind the bulb. This optical system collected light and spread it in a specific direction, reaching miles away.
Later, the reflector was moved from behind the light to the front. This narrowed the light beam, allowing it to travel farther but with less brightness. French civil engineer and physicist Augustin-Jean Fresnel developed a single-direction lens with notches, which allowed a narrow beam of light to be shaped into a larger one. His discovery revolutionized the concept of lighthouses.
The first lighthouse built on an ocean floor was in England in the late seventeenth century, called the Eddystone Lighthouse. Built on a submerged hill called Eddystone near the English Channel, many ships had sunk by crashing into this rock during high tide. Ship merchant and sailor Henry Winstanley planned to build a lighthouse there to solve this problem. After three years of tireless effort, the lighthouse was completed in 1698. However, a catastrophic storm destroyed it in 1703. It was rebuilt several times, and in 1882, under the supervision of Sir James N. Douglas, a state-of-the-art lighthouse was built there.
LED lights are now used in lighthouses. They provide more light at a lower cost and are more durable. Moreover, these lights can be controlled remotely using sensors and timers.
Radio beacon technology has also been added to lighthouses, allowing them to send signals to ships on specific frequencies. These signals are picked up by the ship’s navigation system, helping them determine the correct course.
With GPS and AIS technology, ship captains can easily navigate safely by knowing the lighthouse’s location. Currently, there are 18,600 lighthouses in the world, six of which are in Bangladesh.
Remember, at the beginning of the video, I mentioned the dangerous Jument Lighthouse, where the salary is 15 crores per year. What is your decision after all this explanation? Will you take the risk and join that lucrative job, or continue as you are, navigating your life as it is? Share your thoughts in the comments.
Thanks, everyone. Stay healthy and stay well.