আমরা কি জানি, একজন হলিউড সুন্দরীর হাত ধরে এসেছে আজকের ওয়াই-ফাই। তাও ৮৫ বছর আগে। আর হ্যাঁ, বলপেনের কালি আসলে এক হাঙ্গেরিয়ান সাংবাদিকের রাগ থেকেই জন্ম নিয়েছিল। আবার একজন লোক শুধু তার কুকুরকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু সেই হাঁটার ফলাফল আজ পৌঁছে গেছে মহাকাশের প্রযুক্তিতেও! ভাবা যায়? এই ভিডিওতে জানবো সেই অখ্যাত জিনিয়াসদের গল্প, যাদের আইডিয়া বদলে দিয়েছে বিশ্ব। কিন্তু নামগুলো রয়ে গেছে ইতিহাসের আড়ালে।
শুভেচ্ছা সবাইকে।
শুরুতে যার কথা বলবো, তাকে চেনা হয় ‘দ্য মোস্ট বিউটিফুল ওম্যান ইন ফিল্মস’ খেতাব দিয়ে। নাম হেডি লামার। এই অভিনেত্রী সিনেমার পর্দায় বিশ্বজয় করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় লড়াই ছিল- যুদ্ধের প্রযুক্তিকে বদলে দেওয়া। ১৯৪০ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। শত্রুরা রেডিও সিগন্যাল হ্যাক করে টর্পেডোকে ঠেকিয়ে দিচ্ছে। তখন হেডি ভাবলেন- যদি সিগন্যাল এক ফ্রিকোয়েন্সিতে না থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে যায়? সঙ্গীতজ্ঞ জর্জ অ্যান্টেইলের সাথে মিলে বানালেন ফ্রিকোয়েন্সি হপিং। যেখানে সংকেত প্রতি সেকেন্ডে ৮৮ বার ফ্রিকোয়েন্সি বদলাত! শত্রু ধরতেই পারবে না কোথায় আছে সিগন্যাল! এই টেকনোলোজিতে একটি সংকেত এক নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে না থেকে প্রতি সেকেন্ডে বহুবার তার ফ্রিকোয়েন্সি বদলায়। ফলে কেউ যদি সিগন্যাল ধরতে চায়, তাকে প্রতিটি পরিবর্তনের প্যাটার্ন বুঝে ফেলতে হবে—যা প্রায় অসম্ভব। রেডিও চ্যানেল বদলানোর মতো প্রতি সেকেন্ডে আপনাকে চ্যানেল পরিবর্তন করতে হবে বহুবার যদি আপনি শত্রুপক্ষের কথায় কান পাততে চান। আর যখন আপনি জানেনও না কোন ফ্রিকোয়েন্সিতে চ্যানেল বদলাতে হবে, তখন তা অসম্ভবই। বাইরে থেকে কেউ পুরো কথোপকথন ধরতে পারবে না। যুদ্ধের কৌশল ও নির্দেশনা দিতে এটি ছিল এক যুগান্তকারী আবিষ্কার।
কিন্তু নৌবাহিনী এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেনি। কারণ? হেডি ছিলেন একজন নারী, তাও আবার অভিনেত্রী! ৫৫ বছর পর, ১৯৯৭ সালে এল স্বীকৃতি। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে- আজ Wi-Fi, ব্লুটুথ, জিপিএস- সবই চলে এই টেকনোলজিতে।!
১৮০৪ সালের কথা। ফরাসি উদ্ভাবক জোসেফ মারি জ্যাকার্ড একটি যন্ত্র তৈরি করেছিলেন যা শুধু টেক্সটাইল শিল্পে বিপ্লবই আনেনি, বরং আধুনিক কম্পিউটিং প্রযুক্তির দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। তার এই যন্ত্রটির নাম জ্যাকার্ড লুম। আগে যখন কাপড় বোনা হতো তখন একজন দক্ষ কারিগরকে দিনের পর দিন পরিশ্রম করতে হতো একটি জটিল ডিজাইন তৈরি করতে। কিন্তু জ্যাকার্ড লুম এই প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ বদলে দিল। এই যন্ত্রের বিশেষত্ব ছিল এর পাঞ্চ কার্ড সিস্টেম। প্রতিটি পাঞ্চ কার্ডে নির্দিষ্ট প্যাটার্নে ছিদ্র করা থাকত, যা যন্ত্রটিকে বলে দিত কীভাবে সুতো বুনতে হবে। মজার বিষয় হলো, এই পাঞ্চ কার্ড পদ্ধতিই পরবর্তীতে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের ভিত্তি তৈরি করে। আসলে এটাই ছিল বাইনারি কোডের প্রাথমিক রূপ – যেখানে ছিদ্র করা অংশগুলো ‘১’ আর অচ্ছিদ্র অংশগুলো ‘০’ এর মতো কাজ করত। এই উদ্ভাবন শুধু টেক্সটাইল শিল্পকে পরিবর্তনই করেনি, এটি বিজ্ঞানী চার্লস ব্যাবেজকেও অনুপ্রাণিত করেছিল। ব্যাবেজ জ্যাকার্ড লুমের এই পাঞ্চ কার্ড সিস্টেম ব্যবহার করেই তার বিখ্যাত অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন ডিজাইন করেছিলেন, যাকে আজ আমরা কম্পিউটারের পূর্বপুরুষ হিসেবে জানি। ভাবতে অবাক লাগে না? আজ আমরা যে ডিজিটাল যুগে বাস করছি, তার সূচনা হয়েছিল একটি সুতো বোনার মেশিন থেকে!
এবার বলবো এমন একজনের কথা যার আবিষ্কারের প্রত্যক্ষ উপকারভোগী বলতে গেলে গোটা পৃথিবীর সবাই। তিনি হলেন হাঙ্গেরিয়ান সাংবাদিক ও উদ্ভাবক লাজলো বাইরো। ১৯৩৮ সালে তার হাত ধরেই উদ্ভাবন হয় বলপয়েন্ট পেন বা কলমের। বাইরো যেহেতু পেশায় সাংবাদিক, আর প্রতিদিন তাড়াহুড়ার মধ্যে খবর লিখতে গিয়ে তার বিরক্তির শেষ থাকত না—ফাউন্টেন পেনে কালি ছড়িয়ে যেত, মাঝপথে থেমে যেত লেখাও, আর বাইরো মিস করতেন জরুরী সংবাদের নোট নিতে। এমনই একদিন রাগের মাথায় ভাবলেন, এমন কিছু দরকার যা হবে ঝামেলাহীন। সেই রাগ ও বিরক্তি থেকেই মাথায় এলো বলের সাহায্যে কালি দেওয়ার অভিনব পদ্ধতির চিন্তা। মজার ব্যাপার হলো, ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্স এই কলম এতই পছন্দ করল যে যুদ্ধবিমানের পাইলটদের জন্য বানাল বিশেষ সংস্করণ! আজ পৃথিবীর প্রতিটি ডেস্ক, ব্যাগ বা পকেটে যে বলপেন দেখা যায়, তার পেছনে আছে একজন সাংবাদিকের রাগের মাথার আবিষ্কার।
১৯৪১ সালের এক সাধারণ দিনে সুইস প্রকৌশলী জর্জ দেসট্রো তার কুকুর নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন – কিন্তু কখনো ভাবেননি এই হাঁটাটি সারা বিশ্বের জন্য এক বিপ্লব নিয়ে আসবে! কুকুরের পশমে আটকে থাকা বুনো কাঁটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎই মাথায় এলো এক যুগান্তকারী আইডিয়া। দেসট্রো লক্ষ্য করলেন, প্রকৃতির এই ডিজাইন – যেখানে ছোট কাঁটা সহজেই কাপড়ে আটকে যায় কিন্তু খুলেও যায় নিঃশব্দে – তা মানুষের জন্য পারফেক্ট ফাস্টেনার হতে পারে। এরপর তিনি তৈরি করলেন ভেলক্রো। এই ভেলক্রোতে থাকে দুই ধরনের স্ট্রিপ—একদিকে থাকে ছোট ছোট হুক বা কাঁটা, আর অন্যদিকে থাকে নরম লুপ। যখন এই দুইটা একসাথে চাপ দিয়ে লাগানো হয়, তখন হুকগুলো লুপে আটকে যায়, তৈরি হয় একধরনের মজবুত গ্রিপ। তবে টান দিলে আবার সহজেই আলাদা হয়ে যায়। পুরো নকশাটাই প্রকৃতির অনুপ্রেরণায় তৈরি।
একটি কুকুরের হাঁটা থেকে শুরু হয়ে আজ ভেলক্রো পৌঁছে গেছে মহাকাশ পর্যন্ত! ভেলক্রো শুধু মহাকাশ কিংবা পৃথিবীতে পোশাক এবং জুতোর জন্যই নয়, এটি চিকিৎসার বিভিন্ন ডিভাইসেও বহুল ব্যবহার হয়ে আসছে।
এবার বলবো মার্কিন বিজ্ঞানী ফো ফার্নসওর্থ নিয়ে। যিনি ১৯২৭ সালে প্রথম বৈদ্যুতিক টেলিভিশন উদ্ভাবন করেন। ফো ফার্নসওর্থ ছিলেন একজন কৃষকের ছেলে। অত্যন্ত মেধাবী এই মানুষটির আবিষ্কার শুধু টেলিভিশন শিল্পের ভিত্তি স্থাপন করেনি, বরং এটি আধুনিক গণমাধ্যমের যুগের সূচনা করে দিয়েছে। ফার্নসওর্থের সিস্টেমের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো চলমান চিত্র ইলেকট্রনিকভাবে ধারণ এবং সম্প্রচার করা সম্ভব হয়েছিল। এর ফলে, টেলিভিশন আমাদের ঘরের অংশ হয়ে ওঠে, এবং বিশ্বব্যাপী ঘটনাবলী সরাসরি আমাদের সামনে চলে আসে।
মাত্র ১০০ বছর আগের কথা… যখন ফ্রিজ মানে ছিল শুধুই একটি কাঠের আলমারি, যার ভেতর বরফের টুকরো দিয়ে ঠাণ্ডা রাখতে হতো খাবার! সকালের বাজারের সাথে বরফ কিনে সে আলমারিতে রাখতে হতো, আবার বিকেল নাগাদ তা গলে যেত – আবার দৌড়াও বাজারে, নতুন বরফ আনতে। কি অসুবিধাই না ছিল।
ফ্রিজের সবচেয়ে বড় উপকারী দিক হচ্ছে আমাদের প্রতিদিন বাজারে যেতে হয় না। কিন্তু ফ্রিজ মেইনটেইন করার জন্যই যদি প্রতিদিন সকাল বিকাল বাজারে ছুটতে হয়, তারচেয়ে বড় বিড়াম্বনা আর কী হতে পারতো, বলুন তো?
ভাগ্যিস ১৯১৩ সালে এক আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার সব বদলে দিলেন। ফ্রেড ডব্লিউ. ওল্ফ নামের এই বুদ্ধিমান মানুষটি বানালেন বিশ্বের প্রথম বৈদ্যুতিক ফ্রিজ। “বরফ ছাড়াই খাবার ঠাণ্ডা রাখা”- তখনকার মানুষদের জন্য এটা যেন রীতিমতো জাদুর মতো! আজকের স্মার্ট ফ্রিজ অবশ্য আপনাকে বলেও দেয় কখন দুধ ফুরিয়ে আসছে, কিন্তু এ সবের শুরুটাই হয়েছিল ওল্ফের বানানো ফ্রিজটার মাধ্যমে, ভাবতে অবাক লাগে না? একটা আবিষ্কার কীভাবে পাল্টে দিতে পারে কোটি কোটি মানুষের জীবনযাত্রা!
১৮৫২ সাল, নিউইয়র্কের এক প্রদর্শনী। এলিশা ওটিস নামের এক মার্কিন উদ্ভাবক দাঁড়িয়ে আছেন একটি এলিভেটরে। হঠাৎ তিনি কুড়াল দিয়ে কেটে ফেললেন লিফটের রোপ! দর্শকদের চোখ কপালে। সবাই ভাবছে এখনই ঘটবে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। কিন্তু না! লিফট মাত্র কয়েক ইঞ্চি নেমেই আটকে গেল। এই ছিল বিশ্বের প্রথম ‘অটোমেটিক সেফটি ব্রেক’ । যেখানে স্প্রিং-লোডেড মেকানিজম ক্যাবল ছিঁড়ে গেলেই লক হয়ে যায় লিফট। এই আবিষ্কারের আগে লিফটে চড়া মানেই ছিল রীতিমতো জীবন বাজি রাখা! ৫ তলার বেশি বাড়ি বানানোর চিন্তাও ছিল একরকম পাগলামি। কে উঠবে এত সিঁড়ি বেয়ে? ওটিসের সেফটি সিস্টেম আসার পরই জন্ম নিল স্কাইস্ক্র্যাপার। আজকের দুবাইয়ের বুরজ খলিফা থেকে নিউইয়র্কের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং- সবই সম্ভব হয়েছে এই একটি আবিষ্কারে। ওটিস না থাকলে আজ আমাদের শহরগুলো হত সম্পূর্ণ আলাদা।
এমন আরও বহু বহু ছোট বড় আবিষ্কার আছে যেগুলো হয়তো আমাদের জীবনযাত্রাকে আরও অনেক বেশি সহজ করে তুলেছে। কিন্তু সেগুলো আসলে কীভাবে এলো, কাদের ব্রেইন চাইল্ড, এসব আমরা কজনই বা মনে রেখেছি। হেডি লামারের Wi-Fi, বাইরোর বলপেন, ওটিসের লিফট- এগুলো শুধু যন্ত্র নয়, মানবসভ্যতার ইনভিসিবল সুপারপাওয়ার! আজ আমরা যেসব প্রযুক্তিকে সাধারণ মনে করি, ১০০ বছর পর কি কেউ মনে রাখবে এর পেছনের মানুষগুলোকে?
পরের বার যখন Wi-Fi কানেক্ট করবেন, কলমে সই করবেন বা লিফটে চাপ দেবেন- এক মুহূর্ত থামুন। আর ভাবুন সেই অদৃশ্য হিরোদের, যাদের মস্তিষ্কপ্রসূত এসব জিনিস আপনাকে প্রতিদিনের যুদ্ধে অদৃশ্য সুপারপাওয়ার দিচ্ছে!
ইনোভেশন কখনো একা আসে না। এটা একটা চেইন রিঅ্যাকশন! আজকের স্মার্টফোন, স্পেস টেকনোলজি- সবই দাঁড়িয়ে আছে এই ভুলে যাওয়া উদ্ভাবকদের কাঁধে।
ধন্যবাদ সবাইকে।
সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।