বাটা শু কোম্পানি আসলে কীভাবে বাংলাদেশে এলো? এ নিয়ে আছে নানা মতামত, আলোচনা আর প্রশ্ন—এই বাটা আসলে কোন দেশের ব্র্যান্ড? কী এই ব্র্যান্ডের আসল গল্প?
আজকের ভিডিওতে থাকছে সেইসব প্রশ্নের জবাব।
আরো জানবো কীভাবে এক জুতার কারিগর নজর কেড়েছিলেন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের? কীভাবে একটা ছোট কোম্পানি হয়ে ওঠে জুতা জগতের সুপারস্টার, আর বাংলাদেশে বাটার যাত্রা শুরু হয়েছিল ঠিক কোথা থেকে?
সাথেই থাকুন, কারণ এই গল্প শুধু ব্যবসার নয়, ভীষণ অনুপ্রেরণারও। এ যেন এক অপূর্ব স্বপ্নপূরণের গল্প!
***
শুভেচ্ছা সবাইকে।
একদিন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে এলো এক ভদ্রলোকের জীবনী। যিনি ছিলেন একজন জুতার কারিগর। বিভূতিবাবু কৌতূহল নিয়ে জীবনীটি পড়লেন।
পড়ার পর বিভূতিভূষণ এতটাই মুগ্ধ হলেন যে, নিজেই সেটি বাংলায় অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। শুধু অনুবাদ করেই থামলেন না, তার মনে হলো- এই বইটি চাকরীপ্রত্যাশী সব তরুণ-তরুণীর পড়া উচিত। তিনি ছুটে গেলেন প্রখ্যাত রসায়নবিদ, দার্শনিক ও শিক্ষক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কাছে।
বইটি পড়ে প্রফুল্ল রায়ের এতটাই ভালো লাগলো যে, তিনি নিজেই বইটির ভূমিকা লিখে দিলেন। অবশেষে ছাপা হলো বইটি। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার, এটি তেমন জনপ্রিয়তা পেলো না। কারণ? জুতার কারিগরের জীবনকাহিনি পড়ার আগ্রহ ক’জনেরই বা থাকে।
সময় অনেক গড়িয়েছে, বদলেছে বহুকিছু। আজ সেই জুতার কারিগরকে সারাবিশ্ব চেনে। তার নাম টমাস বাটা, যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাটা শু কোম্পানি। যে ব্র্যান্ড সারা পৃথিবীর মানুষের পায়ের নিচে জায়গা করে নিয়েছে। এই গল্প কেবল একটি সফল ব্যবসার গল্প নয়, এটি স্বপ্নের গল্প, সংগ্রামের গল্প, মানুষের জন্য কিছু করে যাওয়ার গল্প। আসুন, আজ আমরা টমাস বাটার জীবনের সেই অনুপ্রেরণামূলক যাত্রার কথা জেনে আসি।
টমাস বাটার জন্ম ১৮৭৬ সালে, চেকোস্লোভাকিয়ার একটি ছোট শহরে। বাবা ছিলেন একজন দক্ষ চর্মকার। ১০ বছর বয়সে মা-কে হারান টমাস।
অবশ্য ৬ বছর বয়স থেকেই টমাস তার বাবার কাছে চামড়ার কাজ শিখতে শুরু করেছিলেন। বাতিল চামড়া দিয়ে বুড়ো আঙুলের মাপে ছোট্ট আকৃতির সব জুতা বানাতেন তিনি। ছোট হলেও জুতাগুলো দেখতে এতই সুন্দর ছিল যে, মানুষ সেই ছোট জুতাগুলোও কিনে নিয়ে যেত। ১২ বছর বয়সেই জুতা তৈরিতে দারুণ পারদর্শী হয়ে ওঠেন টমাস। ছোট জুতা বানানো এই ছেলেটির স্বপ্ন কিন্তু কখনোই ছোট ছিল না। তিনি কেবল জুতা বানাতে চাননি, চেয়েছিলেন মানুষের জীবনকে সহজ করতে।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে টমাস তার দাদা অ্যান্তোনিন এবং দিদি অ্যানাকে বুঝিয়ে বলেন, ‘একটা ছোট্ট দোকান থেকে আর কটাই বা জুতা বিক্রি হবে? চলো আমরা তিন ভাইবোন মিলে একটা জুতোর কোম্পানি বানাই। তাতে জুতা বিক্রি হবে অনেক বেশি, আর সে কোম্পানিতে কর্মসংস্থানও হবে কিছু মানুষের।”
সবমিলিয়ে কেবল ৩২০ ডলার জোগাড় করতে পেরেছিলেন তিন ভাইবোন। আর সেই টাকা দিয়ে ১৮৯৪ সালে তারা প্রতিষ্ঠা করলেন বাটা শু কোম্পানি। শুরুটা মোটেও সহজ ছিল না।
১০ কর্মী নিয়ে শুরু করা কোম্পানি প্রথম বছরেই একরকম দেউলিয়া। এমন অবস্থা, জুতা বানানোর জন্য চামড়া কেনার টাকাও নাই। অন্য কেউ হলে হয়তো ব্যবসা গুটিয়ে নিতেন, কিন্তু টমাস বাটা হাল ছাড়তে শেখেননি। আবার তিনি সেই শুন্য থেকেই শুরু করলেন। চামড়ার দাম বেশি হওয়ায় ক্যানভাস কাপড় দিয়ে শুরু করলেন জুতা তৈরি। যা ছিলো দামের দিক দিয়ে সস্তা আর সহজলভ্য।
এভাবেই তৈরি হলো পৃথিবীর প্রথম ক্যানভাসের জুতা, যেটিকে আমরা আজ কেডস বলি। অবশ্য বাটাই প্রথম ক্যানভাসের জুতা বানিয়েছে কিনা, তা নিয়ে কিছু বিতর্কও আছে। তবে বাটা কোম্পানিই যে প্রথম কেডস জুতাকে জনপ্রিয় করেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বাটার কেডস জুতা প্রথমবারের মতো বাজারে আসা মাত্রই সুপারহিট হয়ে যায়! টমাস বাটা একবছরের মধ্যে দেনা শোধ করেন, ঘুরে দাঁড়ায় টমাসের কোম্পানি।
টমাস বুঝতে পারলেন, উৎপাদন বাড়াতে হলে প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হবে। আমেরিকার আবিষ্কার অ্যাসেম্বলি লাইন পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারলে দ্রুত সময়ে বিপুল পরিমাণ উৎপাদনে যাওয়া যাবে। তিনি চলে গেলেন আমেরিকা। সেখানে তিনি হাতে-কলমে শিখলেন কীভাবে দ্রুত এবং দক্ষ হাতে জুতা তৈরি করা যায়। এরপর সেটি বাটা ফ্যাক্টরিতে প্রয়োগ করলেন।
শুধু উৎপাদন বাড়ালেই তো হয় না, দরকার ভোক্তাদের জন্য সঠিক কৌশল। তিনি লক্ষ্য করলেন, বেশিরভাগ মানুষ তখনো ব্যয়বহুল চামড়ার জুতা পরতে পারে না। তাই তিনি ‘Mass Production’ পদ্ধতি গ্রহণ করলেন, যা স্বল্প খরচে বেশি সংখ্যক জুতা তৈরি করা সম্ভব করল।
তার কোম্পানির পরিধি বাড়তে থাকলো। শুধু চেকোস্লোভাকিয়াতেই নয়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কারখানা গড়ে তুলতে থাকলেন। টমাসের প্র্যাকটিক্যাল চিন্তাভাবনা ছিল অসাধারণ। একবার তাকে একটি স্কুলে বক্তৃতা দিতে ডাকা হয়েছিল। ক্লাসে গিয়ে দেখেন বাচ্চারা মিশ্রণের অনুপাত নিয়ে জটিল অঙ্ক করছে ব্ল্যাকবোর্ডে। তিনি বললেন, “ফেলে দাও এসব অঙ্ক, চলো কেক বানাই!” সত্যি সত্যি কেক বানিয়েই তিনি বাচ্চাদের মিশ্রণ আর অনুপাতের অঙ্ক সহজে মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন!
সমস্যার বাস্তব সমাধান টমাসের ব্যবসায়িক কার্যক্রমেও দেখা যায়। একবার দেখা গেলো কারখানা থেকে শোরুমে নিয়ে যাওয়ার পথে চুরি যাচ্ছে জুতোর বাক্স! কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছিলো না চুরি। সবাই টমাসকে সিকিউরিটি গার্ড ভাড়া করার পরামর্শ দিলো। কিন্তু তিনি বললেন, “প্রথমে বাঁ পায়ের সব জুতা পাঠিয়ে দাও, তার দু’দিন পর ডান পায়ের।” রাস্তা থেকে জুতা চুরি রাতারাতি বন্ধ হয়ে গেলো!
তার জুতোর দামও তিনি অদ্ভুতভাবে ৯ সংখ্যাটা দিয়ে শেষ করতেন। তিনি বুঝেছিলেন, ১০০ টাকার জায়গায় ৯৯ লিখলে ক্রেতার মাথায় থাকবে, “একশো টাকারও কমে পেলাম!” সেই ট্র্যাডিশন কিন্তু আজও আছে। আর গবেষণায়ও দেখা যায়, ৯০০ কিংবা ৯৯৯ সংখ্যাগুলো ক্রেতাদের একরকম মানসিক শান্তি দেয়।
বাংলাদেশে বাটার ইতিহাস শুরু হয় ১৯৬২ সালে, যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান – বর্তমান বাংলাদেশের টঙ্গীতে বাটার প্রথম ফ্যাক্টরি স্থাপিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, বাটা কোম্পানি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশে বাটা শুধু জুতা বিক্রি করেনি, এটি হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা শহর মিলিয়ে তিনশোর বেশি রিটেইল স্টোর বা শো-রুম আছে বাটার। টঙ্গী আর ধামরাইয়ের দুইটি ফ্যাক্টরি থেকে বাংলাদেশে বাটার স্থানীয় উৎপাদন হয়।
১৯৩২ সালে সুইজারল্যান্ডে কোম্পানির একটি শাখায় ভ্রমণ করতে গিয়ে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান টমাস বাটা। কিন্তু তার স্বপ্ন এবং লেগেসি আজও বেঁচে আছে। বাটা কোম্পানির হেডকোয়ার্টার এখন সুইজারল্যান্ডে, এবং এটি বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশে তার পণ্য বিক্রি করছে।
টমাস বাটার গল্প আমাদের শেখায় যে, কোন স্বপ্নই ছোট নয়। তিনি একজন সাধারণ জুতার কারিগরের ছেলে হয়েও কিভাবে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। তার পরিশ্রম, হার নামা মানা চেষ্টা, উদ্ভাবনী চিন্তা, এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা তাকে একজন সফল ব্যবসায়ী এবং সমাজসেবকে পরিণত করেছিল।
জুতার গল্প যখন করছিই, অ্যাডিডাস ও পুমার কথা স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্ব থেকে দুটি বিশ্বখ্যাত কোম্পানির শুরু নিয়ে মজার এক গল্প আছে। সে গল্প জানতে দেখে আসতে পারেন এই ভিডিওটি।
জুতা নিয়ে আপনাদের কোন মজার গল্প থাকলে জানাতে পারেন কমেন্টে, কমেন্ট করতে পারেন আপনাদের পছন্দের জুতার ব্র্যান্ডের নামও।
ধন্যবাদ সবাইকে। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।