অনলাইন জুয়া – মানুষ ঠকানোর ফাঁদ। অ্যাপ নাকি ট্র্যাপ? Online Gambling। Ahmed Pipul

অনলাইন জুয়ায় সর্বস্বান্ত

শুভেচ্ছা সবাইকে।

রিফাত। ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। এবার সিমেস্টার ফি’র টাকাটা বাসা থেকে বেশ আগেই নিয়ে রেখেছে সে। প্ল্যান ছিল- অনলাইন বেটিং সাইটে ক্রিকেট ম্যাচের ওপর বাজি ধরে বাড়তি কিছু টাকা আয় করবে। লোভে পড়ে সেমিস্টার ফি’র পুরোটা খুইয়ে সে দিশেহারা। নতুন করে ফি যোগাড় করতে না পারলে সেমিস্টার ড্রপ দেয়া ছাড়া উপায় নেই। ইদানিং অনলাইন জুয়ার ফাঁদে পড়ে অনেক শিক্ষার্থীর অবস্থা রিফাতের মতোই। 

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তানভীর আলম তুষারের গল্পটা আরও মর্মান্তিক। অনলাইন জুয়ায় স্বর্বস্ব হারিয়ে নিজেকেই শেষ করে দিয়েছে সে। 

তরুণদের পাশাপাশি জুয়ার ফাঁদে পা দিচ্ছেন প্রাপ্তবয়স্করাও। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার কাপড় ব্যবসায়ী আকরামুল ইসলাম। স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে সুখী পরিবার। ব্যবসাও চলছে বেশ। হুট করে দেখা গেল, অনলাইন জুয়ার খপ্পরে পরে তার ব্যবসা লাটে উঠেছে। সহায় সম্পত্তি হারিয়ে পরিবার নিয়ে পথে বসেছেন। পাওনাদারদের ভয়ে ঘরবাড়ি-পরিবার ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। লোভে পড়ে নিজের সাথে পরিবারকেও ফেলেছেন বিপদে।

স্কুল শিক্ষিকা রোকসানা খানমের গল্পটাও বেশ বেদনাদায়ক। নিজে কোন জুয়ার সাথে জড়িত ছিলেন না। এতিম ভাতিজাকে নিজের সাথে রেখে বড় করেছেন ছোটবেলা থেকে। আর সেই ভাতিজাই সঙ্গদোষে অনলাইন জুয়ায় হেরে পাওনাদারদের চাপে পড়ে খুন করে ফেলেছেন রোকসানা আলমকে। 

অনলাইন জুয়া- ভাইরাসের মতো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। রংপুরের হারাগঞ্জ পৌরসভার পুরো একটা গ্রামের নামই হয়ে গেছে জুয়ারীদের গ্রাম। লোভের এই ভাইরাসে আক্রান্ত জোয়ান-বুড়ো সবাই।

বুঝতেই পারছেন, অনলাইন জুয়ার এই ভয়াল থাবা শহর ছাড়িয়ে মফস্বল এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামেও পৌঁছে গেছে। সরকার দেশকে ডিজিটাল করতে ঘরে ঘরে ইন্টারনেট পৌঁছে দিয়েছে, আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছু দেশি-বিদেশী চক্র বিনা শ্রমে আয়ের লোভ দেখিয়ে মানুষকে সর্বস্বান্ত করে ছাড়ছে। অন্তত উপরের কেস-স্টাডিগুলো সে বার্তাই দিচ্ছে। 

উপমহাদেশে জুয়ার ইতিহাস বেশ পুরোনো। মহাভারতে তো স্ত্রী দ্রোপদীকে বাজি রেখেই পান্ডবরা জুয়া খেলেছিলো। আবার সম্রাট আকবরের সময়ে মোরগ লড়াইয়ে বাজি ধরা হতো। ইতিহাস যতোই পুরোনো হোক- জুয়া সবসময় ছিলো নিকৃষ্ট একটি ব্যাপার।

কিন্তু এখন? জুয়ার ধরণ পাল্টেছে। বৈধতা দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এটাকে বিরাট লাভজনক ব্যবসাও বানিয়ে ফেলেছে। আমাদের দেশের অবস্থাও খারাপ। বেআইনি হওয়া সত্ত্বেও ঢাকার অভিজাত ক্লাব থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকান এমনকি সেলুনেও চলে জুয়ার আসর। শুধু দরকার একটা স্মার্টফোন। অবশ্য না থাকলেও চলে। অন্যের ফোন ব্যবহার করেও জুয়ায় অংশ নেয় বহু মানুষ।

আমাদের উপমহাদেশে ক্রিকেট নিয়েই সবচেয়ে বেশি জুয়া হয়। ভারতে তৃতীয় কোন পক্ষ দ্বারা পরিচালিত জুয়া অবৈধ হলেও সরাসরি প্লেয়ার টু প্লেয়ার বেটিং বৈধ। আরব আমিরাতে আবার ভিন্ন নিয়ম। তারা শুধু বিদেশী নাগরিকদের জন্য জুয়া বৈধ রেখেছে। অথচ ক্রিকেট নিয়ে অনলাইন বেটিং অ্যাপগুলো বেশিরভাগই পরিচালিত হয় ভারত আর আমিরাত থেকে। এসব অ্যাপের অথোরিটি থাকে একরকম ধরাছোঁয়ার বাইরে।   

বিভিন্ন দেশের প্রিমিয়ার লীগ- যেমন বিপিএল, পিসিএল, সিপিএল, আইপিএলের মতো জনপ্রিয় ক্রিকেট টুর্নামেন্টের সময় তো কথাই নাই। ঘন্টায় বাজির দান কোটি ছাড়িয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনলাইন জুয়ার টাকা লেনদেন হয় মোবাইল ব্যাংকিংয়ে। যারা বাজি ধরেন তারা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পেলেও, শুরুর বাজি ধরার টাকাটা জমা হয় ডার্ক ওয়েবে। যার হদিস বিশ্বের বেশিরভাগ গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও নেই।

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপ সামনে রেখে নতুন করে আঁটঘাট বেঁধে নামছেন এসব বেটিং মাফিয়ারাও। গোপনে দেশব্যাপি এজেন্ট নিয়োগ থেকে শুরু করে অনলাইনে বিজ্ঞাপনের ঝড়, সবই চলছে। ক্রিকেটার থেকে শুরু করে মুভি স্টারদের দিয়ে বিজ্ঞাপন বানানো হচ্ছে, প্রচারিত হচ্ছে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এমনকি টিভিতেও। আইপিএলের মতো টুর্নামেন্টে বাউন্ডারি লাইনের বোর্ডেও বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন চলে। ম্যাচ চলাকালে ক্রমাগত এসব বিজ্ঞাপন দেখিয়ে মানুষকে প্রলুব্ধ করা হয়।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ – সিআইডি’র তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ অনলাইন জুয়ায় জড়িত। তারা বিকাশ-নগদের মতো মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিসের মাধ্যমে মাসে ১৫০ কোটি টাকার বেশি অবৈধভাবে লেনদেন করে। এভাবে বছরে লেনদেন হচ্ছে ১৬০০ থেকে ২ হাজার কোটি টাকা। এই বিশাল অংকের অর্থ ভার্চুয়াল মুদ্রায় রূপান্তরিত করে এবং হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। বাস্তবে জুয়ার এই বাজার সিআইডির দেয়া হিসাবের চেয়ে অনেক বড়।

উদাহরণ হিসেবে আইপিএলের কথাই বলি। এবারের আইপিএলে সর্বোচ্চ দাম মিচেল স্টার্কের, পৌনে পঁচিশ কোটি রূপি। শুধু একজন প্লেয়ারের পেছনেই যদি এতো টাকা খরচ করা হয়, তাহলে গোটা দল কিনতে কত টাকা লাগবে, একবার ভাবেন তো! এক মৌসুমে প্লেয়ার, কোচ, ট্রেইনার, ফিজিশিয়ান কিনতে যে পরিমাণ টাকা লাগে, তা কি আদৌ স্পন্সর, টিভি রাইটস আর প্রাইজমানি থেকে ওঠানো সম্ভব? তাই প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যায়, ম্যাচ ফিক্সিংয়ের। আর এই ম্যাচ ফিক্সিংয়ের পেছনে থাকে জুয়াড়িরা। বাংলাদেশের আশরাফুল, সাকিব আল হাসান, ভারতের শ্রীশান্ত, পাকিস্তানের আসিফ, আমিরের মতো দুর্দান্ত প্লেয়াররা নিষিদ্ধ হয়েছে এসব জুয়াডিদের খপ্পরে পড়ে। তাই বেটিং এর সাথে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের যে স্পষ্ট যোগাযোগ আছে, তা নিশ্চিত।

তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, ম্যাচ ফিক্সিং হচ্ছে না, তবুও এই সাম্রাজ্য যে কত বিশাল, তা কল্পনারও বাইরে। গবেষণার তথ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টা বলছে, ২০২৩ সালে অনলাইন স্পোর্টস বেটিং থেকে ওয়ার্ল্ডওয়াইড রেভ্যুনিউ ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। অথচ সাত বছর আগেও এই রেভ্যুনিউ ছিল ১২ বিলিয়ন ডলার। বুঝতেই পারছেন, অনলাইন জুয়ার পরিধি কী পরিমাণে বেড়েছে!

এ তো গেল লিগ্যাল বেটিং অ্যাপের আয়। অবৈধ বহু অ্যাপ চলছে কর্তৃপক্ষের চোখের আড়ালে। আর এ অ্যাপগুলো শুধু বেটিংই নয়, স্ক্যামের সাথেও জড়িত।

অনলাইন বেটিংয়ের জাল ছড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কিন্তু সমাধান কোথায়? বাংলাদেশে জুয়ার বিপরীতে এখনো ব্রিটিশ আমলের আইনই চলছে। ১৮৬৭ সালের পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট আইনে, জুয়া পরিচালনায় যুক্ত প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ তিন মাসের জেল অথবা ২০০ টাকা জরিমানা হবে। আর জুয়া খেলা অবস্থায় কাউকে ধরা গেলে তার সর্বোচ্চ এক মাসের জেল অথবা ১০০ টাকা জরিমানা করা হবে। অবশ্য, ২০২৩ সালে জুয়া নিয়ে খসড়া একটি আইনের প্রস্তাব করা হয়। এতে অনলাইন বেটিংয়ের সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছরের জেল অথবা ১০ লাখ টাকা জরিমানা। খসড়া এই প্রস্তাবনা কবে পাশ হবে তা এক্ষুনি বলা যাচ্ছে না।  

এদিকে অনলাইন বেটিং মানুষকে সর্বস্বান্ত করার পাশপাশি দেশে গুম-খুন, চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধগুলো বাড়িয়ে দিয়েছে। অনলাইন জুয়া ভাইরাসের শেঁকড় এতোটাই গভীরে পৌঁছে গেছে, শুধু আইন প্রয়োগ করে এটা নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। কঠোর আইন প্রণয়নের পাশাপাশি মানুষকে এই দুষ্ট চক্র থেকে রেহাই দিতে প্রয়োজন সর্বস্তরের উদ্যোগ। 

সন্তান কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কাদের সাথে মিশছে- এ বিষয়গুলো বাবা-মার খেয়াল রাখতে হবে। ছোটবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষার ব্যাপারে জোর দিতে হবে। জুয়া ব্যাপারটা কতটা খারাপ তা ছেলেবেলাতেই মনে গেঁথে দিতে হবে। জুয়ারীদের সামাজিকভাবেই বয়কট করতে হবে। পাশাপাশি জুয়া পরিচালনা করা রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর ব্যবস্থা নিলেই মিলবে এই সমস্যা থেকে মুক্তি।

ধন্যবাদ সবাইকে। 

সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।  

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top